বুধবার, ১৩ জুন, ২০১২

মিয়ানমার হোক আমাদের ‘প্রথম বন্ধুরাষ্ট্র’






ড. ফে র দৌ স আ হ ম দ কো রে শী
মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের খবরটি উদ্বেগজনক। বিশেষ করে গত কয়েক মাসের ঘটনাপ্রবাহে দু’দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে যে আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি হতে চলেছিল, তার প্রেক্ষাপটে এ ঘটনাটি একেবারেই অনাকাক্সিক্ষত। 
মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সমুদ্রসীমা বিরোধের নিষ্পত্তি হয়ে গেছে আন্তর্জাতিক আদালতে। যদিও কূটনৈতিক ও আইনি মোকাবেলায় বাংলাদেশ পক্ষের অদক্ষতার কারণে ’৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকারের সঙ্গে সম্পাদিত সমঝোতা থেকে পিছু হটে আমাদের অনেক ক্ষতি মেনে নিতে হয়েছে। তবে উভয় পক্ষই আদালতের মীমাংসা মেনে নেয়ার ফলে সমুদ্র এলাকায় এ প্রতিবেশীর সঙ্গে একযোগে কাজ করতে এখন আর কোন বাধা নেই। 
দুু’দেশের ¯’ল সীমান্ত মাত্র ২৪৭ কিলোমিটার। যার একাংশ নাফ নদী দ্বারা নির্দিষ্টরূপে চিহ্নিত। অবশিষ্ট অংশ দুর্গম পাহাড়ি এলাকা। সেখানেও সীমানা নিয়ে কোন সমস্যা নেই। 
ভৌগোলিক অব¯’ান, ঐতিহাসিক পরম্পরা এবং পারস্পরিক স্বার্থ বিবেচনায় আমাদের এ দুটি দেশের মধ্যে গোড়া থেকেই গভীর ও ব্যাপক পারস্পরিক আদান-প্রদান প্রত্যাশিত ছিল। বিশেষ করে বাংলাদেশের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চীনের সরাসরি যোগাযোগের ক্ষেত্রে সেতুবন্ধ হিসেবে মিয়ানমার বাংলাদেশের ‘প্রথম বন্ধুরাষ্ট্র’ বিবেচিত হবে সেটাই ছিল স্বাভাবিক। কিš‘ দুর্ভাগ্যবশত স্বাধীনতার পর বিগত ৪০ বছর এ অতীব গুর“ত্বপূর্ণ বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত হয়েছে। কোন সরকারই বিষয়টির দিকে প্রয়োজনীয় গুর“ত্ব আরোপ করেনি। 
দুই
একটিমাত্র সমস্যা দীর্ঘকাল ধরে দু’দেশের সম্পর্কে ক্ষত হয়ে আছেÑ ‘রোহিঙ্গা’ সমস্যা। রোহিঙ্গা নামে পরিচিত এ জনগোষ্ঠী মিয়ানমারে রাখাইন (আরাকান) রাজ্যের একটি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। এ রাজ্যের জনগণের মধ্যে বেশ কয়েকটি গোষ্ঠী মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে আছে। সেখানে কয়েকটি সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীও আছে। কিš‘ এর সবই মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের এতে নাক গলানোর কোন সুযোগ নেই। 
রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ২০ ভাগের বেশি। জাতিসংঘের এক জরিপে (২০০৯) রোহিঙ্গা জনসংখ্যা ৭ লাখ ২৩ হাজার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রাজ্যের সংখ্যাগুর“ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে বিরোধের জের ধরে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা তাদের বাড়িঘর ছেড়ে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের আশ্রয় শিবিরগুলোতে দীর্ঘকাল ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছে। 
রোহিঙ্গারা ইসলাম ধর্মাবলম্বী বিধায় তাদের প্রতি বাংলাদেশের মুসলমানদের কিছুটা সহানুভূতি রয়েছে। রোহিঙ্গারাও সেই সহানুভূতির সুযোগ নিয়েছে। তারা নানা ছল-ছুতায় বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে। বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ২ লক্ষাধিক। তারা অনেকে শরণার্থী শিবির ছেড়ে দেশের অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অনেকে বাংলাদেশের পাসপোর্ট সংগ্রহ করে সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে চলে যায়। সেসব দেশে তারা এমন কিছু কাজ করেছে যা বাংলাদেশের সুনাম ও স্বার্থহানি ঘটিয়েছে। অপরদিকে তাদের একটি অংশ মৌলবাদী ধ্যন-ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আরাকানে একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের স্লোগান তুলে এক নাজুক পরি¯ি’তির উদ্ভব ঘটিয়েছে। মিয়ানমার সরকার এ ব্যাপারে কঠোর অব¯’ান নেয়ায় সাধারণ রোহিঙ্গাদের জীবন সেখানে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। ফলে তারা দলে দলে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে প্রবেশ করে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে নানা উটকো ঝামেলার উদ্ভব ঘটিয়ে চলেছে। যত শিগগিরই সম্ভব বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় পক্ষের খোলামনে আলোচনার টেবিলে বসে এ সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। 
রোহিঙ্গা ইস্যু বাদ দিলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে বিবাদের এখন আর কোন ক্ষেত্র নেই। বিপরীতে এ দু’দেশের পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে উভয় দেশের লাভবান হওয়ার ক্ষেত্র অনেক বিশাল। এবারে কী কারণে রাখাইন রাজ্যে বৌদ্ধ ও মুসলমান নাগরিকদের মধ্যে সংঘাতের উদ্ভব, তার চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণে গিয়ে লাভ নেই। উভয় পক্ষ পরস্পরকে দোষারোপ করছে। এখন সর্বাগ্রে এ পরি¯ি’তির লাগাম টেনে ধরার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। 
স্বস্তির বিষয়, মিয়ানমার সরকার অতি দ্র“ত দাঙ্গাকারীদের বির“দ্ধে কঠোর অব¯’ান নিয়েছে। আশা করা যায় পরি¯ি’তির আর অবনতি ঘটবে না এবং রাখাইন রাজ্যের জনগণের জীবনযাত্রা শিগগিরই স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
রাখাইন রাজ্যের এ গোলযোগ একান্তভাবেই মিয়ামারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। সেই গোলযোগ সীমান্তের এপারে চলে আসার সব পথ বন্ধ করার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। বাংলাদেশ সরকার সীমান্তে কঠোর নজরদারি বহাল রেখেছে। বাংলাদেশের জনগণ, বিশেষ করে আমাদের সীমান্তবর্তী টেকনাফ অঞ্চলের জনগণকে ধৈর্য ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে এ অনাকাক্সিক্ষত পরি¯ি’তির অবসান ঘটানোর কাজে সহায়ক থাকতে হবে।
রোহিঙ্গা সম্প্র্রদায়কেও বাস্তবতা অনুধাবন করতে হবে। তাদের রাখাইন রাজ্যের সংখ্যাগুর“ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সহাব¯’ানে অভ্যস্ত হতে হবে এবং মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলেই তাদের ভবিষ্যৎ নির্মাণে সচেষ্ট হতে হবে। 
মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন মহলকেও আরাকান অঞ্চলের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট মনে রেখে সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গিতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ন্যায়সঙ্গত অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। 
তিন
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে কিছু গুর“ত্বপূর্ণ ইতিবাচক পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। আগামী মাসে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের কথা রয়েছে এবং সে সময় দুই দেশের মধ্যে কিছু গুর“ত্বপূর্ণ চুক্তি ও সমঝোতা স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা রয়েছে। এটি দু’দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক ক্রান্তিকাল। ঠিক এ সময়ে রাখাইন রাজ্যে এ অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা পর্যবেক্ষকদের মনে নানা প্রশ্নের জš§ দি”েছ। 
এটা বিস্ময়কর যে, নিকটতম প্রতিবেশী হওয়া সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে কোন ধরনের সরাসরি সড়ক, নৌ বা বিমান চলাচল নেই। দু’দেশের মধ্যে এলসির মাধ্যমে আমদানি-রফতানিরও কোন ব্যব¯’া নেই। মিয়ানমারে গণতন্ত্র আছে কী নেই, কতটা আছে, সেটা ঠিক করার দায়িত্ব বাংলাদেশের নয়। মিয়ানমারের জনগণকেই তা ¯ি’র করতে হবে। তাছাড়া পৃথিবীর যেসব দেশের সঙ্গে আমরা লেনদেন করছি তার কোথায় গণতন্ত্র কী পরিমাণে আছে সেই নিরিখে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হলে আমাদেরই একঘরে হয়ে পড়তে হবে। (আমাদের দেশেই বা কতটা গণতন্ত্র আছে, সে প্রশ্নও কেউ তুলতে পারেন!) 
বিলম্বে হলেও সুসংবাদ এই যে, দু’দেশের মধ্যে আমদানি-রফতানি ক্ষেত্রে এলসি ব্যব¯’া চালু করা এবং সরাসরি জাহাজ চলাচলের ব্যব¯’া করার বিষয়টি এখন সুরাহা হওয়ার পথে। বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যবহারের জন্য বেসরকারি পর্যায়ে রাখাইন রাজ্য থেকে প্রথমবারের মতো পাথর আমদানি করার একটি উদ্যোগও প্রক্রিয়াধীন আছে। এ প্রক্রিয়া সফলভাবে কার্যকর হলে বাংলাদেশের, বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়নে তা গুর“ত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। 
আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতির টানাপোড়েনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সুসম্পর্ক সব পক্ষের কাম্য না-ও হতে পারে। সেই পটভূমিতে দু’দেশের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টিতে সক্রিয় হওয়ার মতো তৃতীয় পক্ষ কি নেই? যারা কোনভাবেই চাইছে না বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে স্বাভাবিক ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পর্ক গড়ে উঠুক, রাখাইন রাজ্যের চলমান অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার পেছনে তেমন কোন মহলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হাত থাকার বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না। 
আর সে জন্যই এ বিষয়টিতে আমাদের জর“রিভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। 
চার
বাংলাদেশ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সমস্যাকে বরাবরই মানবিক দৃষ্টিতে দেখে আসছে। তবে এ ক্ষেত্রে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রাখাইন রাজ্যে কিছু গোলযোগ দেখা দিলেই রোহিঙ্গারা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। এ অনুপ্রবেশ কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। 
তবে রোহিঙ্গাদের উপলব্ধি করতে হবে, তারা মিয়ানমারের নাগরিক, বাংলাদেশের নয়। আরাকান বা রাখাইন রাজ্যে তারা একটি ছোট সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী তাদের নানাভাবে উস্কানি দিতে পারে। দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। কিš‘ মিয়ানমারের মধ্যেই তাদের সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে। সে দেশের সরকারের কাছেই নিরাপত্তা চাইতে হবে। 
দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা দীর্ঘদিন ধরে শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে অব¯’ান করছে। তাদের এ অসহায় অব¯’ারও দ্র“ত সুরাহা হওয়া দরকার। এ রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকেই বাংলাদেশে এসেছে। সীমান্তবর্তী এলাকার লোকজনের সঙ্গে তাদের কিছু মিল থাকলেই ঢালাওভাবে বিদেশী আখ্যা দিয়ে বিতাড়নের প্রয়াস অনুমোদনযোগ্য নয়। সীমান্তের এপার ওপার ওরকম মিল দুনিয়ার সর্বত্রই আছে। তাদের কথাবার্তা ও চালচলন পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যায়, তারা এ দেশের নাগরিক নয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় আরাকান অঞ্চলটি কয়েক হাজার বছর আগে থেকেই একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজ্য ছিল। অষ্টাদশ শতকে প্রথমবারের মতো এ অঞ্চলটি তার স্বাধীনতা হারায় এবং বর্মী রাজার অধীন¯’ হয়। তা-ও মাত্র অর্ধশতাব্দীর জন্য। তারপরই এ এলাকা ব্রিটিশ শাসনে চলে যায়। ব্রিটিশ শাসনের উত্তরাধিকার হিসেবেই এটি আজ মিয়ানমারের অংশ। মোগল আমলের আগে আরাকান রাজের রাজ্য একপর্যায়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সম্ভবত তখনই ব্যাপকভাবে চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে অনেকে সেখানে গিয়ে বসবাস শুর“ করে। ব্রিটিশ আমলে সেই ধারা অব্যাহত থেকেছে। তাছাড়া খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দী থেকেই আরাকানের সঙ্গে আরব ও মুসলিম যোগাযোগের নিদর্শন পাওয়া যায়। কাজেই রোহিঙ্গারা সেখানে হঠাৎ করে গিয়ে জড়ো হয়নি। তারা ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াতেই ওই এলাকার নাগরিক। 
এখন এদের সামনে রেখে কিছু এনজিও এবং কোন কোন মহল নিজ নিজ এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যা”েছ বলে অভিযোগ রয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী মিয়ানমার তার নাগরিকদের ফেরত নিতে বাধ্য। এ ব্যাপারে জাতিসংঘ শরণার্থী কমিশনকে সক্রিয় করতে হবে। 
মিয়ানমার সরকারের অভিযোগ, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকার কিছু মানুষ সুযোগ বুঝে আরাকানে গিয়ে বসবাস করতে থাকে এবং নিজেদের ‘রোহিঙ্গা’ বলে দাবি করে। এ অভিযোগও গুর“ত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। কোন বাংলাদেশী নাগরিক যদি এভাবে মিয়ানমারে বেআইনি অনুপ্রবেশ করে থাকে, তার বির“দ্ধেও আইনানুগ ব্যব¯’া নিতে হবে। কিছু ব্যক্তির কারণে দু’দেশের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেয়া যায় না। রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো অচিরেই তুলে দিতে হবে। কারণ যতদিন এ ক্যাম্পগুলো থাকবে ততদিন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখা দুষ্কর হবে।
এ ব্যাপারে জাতিসংঘ হাইকমিশনের ধীরে চলা নীতিও অনেক প্রশ্নের জš§ দেয়। এতদিনেও এ সমস্যাটির সমাধান হল না কেন? সমাধানের কার্যকর উদ্যোগই বা কোথায়? 
রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে কোন মহলকেই ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে দেয়া যাবে না।
পাঁচ
মিয়ানমারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনার অনেকগুলো নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। যেমন :
* আশু সম্ভাবনার ক্ষেত্র হ”েছ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে আমাদের পারস্পরিকতা (ঈড়সঢ়ষবসবহঃধৎরঃু) নেই বললেই চলে। আমদানির তুলনায় রফতানি শতকরা ১০ ভাগ মাত্র। সে বিচারে মিয়ানমারের সঙ্গে আদান-প্রদানে অতি উত্তম পারস্পরিকতা থাকবে। আমদানি রফতানিতে উভয় পক্ষে ভারসাম্য থাকবে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে খাদ্যশস্য, কাঠ, গ্যাস, পাথর, অন্যান্য খনিজ, মাছ, পর্যটন, সেবা খাত, হাল্কা যন্ত্রপাতি, আইটি ও ইলেক্ট্রনিক্স, ওষুধ, বস্ত্র, তৈরি পোশাকসহ নানাবিধ ভোগ্যপণ্যের আদান-প্রদানে এ দুই দেশ হতে পারে পরস্পরের প্রধান ব্যবসায়িক অংশীদার। 
* মিয়ানমারের মাধ্যমেই পেতে পারি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চীনের সঙ্গে আমাদের ‘স্বপ্নের সংযোগ’। আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যব¯’ার সঙ্গে সংযুক্তি এবং এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের যৌক্তিক র“ট নির্ধারণের মাধ্যমে বাংলাদেশ পেতে পারে বর্তমানের প্রায়-অবর“দ্ধ ভৌগোলিক অব¯’ান থেকে মুক্তি। 
* মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাভাবিক বাণিজ্যিক আদান-প্রদান চালু হলে মিয়ানমার হয়ে থাইল্যান্ড, চীন, লাওস, কম্পুচিয়া, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বহু গুণে বেড়ে যাবে। 
* সমুদ্র সম্পদ আহরণে যৌথ উদ্যোগ নিয়ে দু’দেশ বঙ্গোপসাগরের ওপর তাদের প্রাপ্য কর্তৃত্ব নিশ্চিত রাখতে পারে। 
* আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের যৌথ অব¯’ান এতদঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্র পাল্টে দেয়। আসিয়ানে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি ও সার্কে মিয়ানমারের অন্তর্ভুক্তির পথ উš§ুক্ত করে। যা বাংলাদেশের প্রতিরক্ষাকে নতুন দিগন্তে ¯’াপন করে। 
* কৃষিতে সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ মিয়ানমারকে তার বিপুল অব্যবহƒত জমি ব্যবহারে আনতে সহায়তার মাধ্যমে মিয়ানমারের সমৃদ্ধিতে বিশেষ অবদান রাখতে পারে। 
* এ রকম আরও অনেক ক্ষেত্র চিহ্নিত হতে পারে। 
শেষ কথা
বঙ্গোপসাগরে সক্রিয় উপ¯ি’তির জন্য চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক তৎপরতা এবং সেই প্রতিযোগিতায় প্রতিবেশী ভারতের জোরদার অংশগ্রহণ বাংলা-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকাকে এখন বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে পাদপ্রদীপের নিচে ¯’াপিত করেছে। এ বহুমুখী তৎপরতার পটভূমিতে বাংলাদেশকে তার ভূমিকা সঠিকভাবে কার্যকর করে স্বীয় স্বার্থ সুনিশ্চিত করতে হবে।
সময়ের এ চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশ সরকার, দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ও সংশ্লিষ্টরা কীভাবে এবং কতটা দ্র“ততার সঙ্গে মোকাবেলা করতে পারেন, তার ভিত্তিতেই এ অঞ্চলের ভবিষ্যৎ রাজনীতি, অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষার গতিপ্রকৃতি নির্ধারিত হবে। 
অতএব মিয়ানমারের সঙ্গে কোন সংঘাত নয়। মিয়ানমার হোক আমাদের ‘প্রথম বন্ধুরাষ্ট্র’। সমুদ্রে আমরা অনেক ছাড় দিয়েছি। এখন প্রয়োজনে অন্যান্য ক্ষেত্রেও যৌক্তিক ছাড় দিয়ে এ লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে।
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী : রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক
ংযধঢ়ংযরহ@মঃষনফ.পড়স 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন