বৃহস্পতিবার, ৭ জুন, ২০১২

‘মাইনাস’ কোন সমাধান নয়




ড. ফে র দৌ স আ হ ম দ কো রে শী 
বর্ষীয়ান আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার রফিক উল হক দুই নেত্রীকে এক টেবিলে বসার জন্য পুনরায় আহ্বান জানিয়েছেন। বেশ কিছুকাল ধরে এই একই আহ্বান অনেকেই ক্রমাগত জানিয়ে চলেছেন। মাহমুদুর রহমান মান্না আরও এক ধাপ এগিয়ে ব্যারিস্টার রফিক উল হককে আহ্বান জানিয়েছেন এই দাবিতে ‘আমরণ অনশন’ করার জন্য। তার মতে, ব্যারিস্টার সাহেব যদি তা করেন তাহলে তার অনশন¯’লে ১০ লাখ লোক জমায়েত হবে এবং ‘দুই নেত্রী’ বাধ্য হবেন এক টেবিলে বসতে। 
দুই নেত্রী এক টেবিলে বসলেই এই দুর্ভাগা দেশের তাবৎ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, দেশজুড়ে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইতে শুর“ করবে, আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট বাতাসে মিলিয়ে যাবেÑ এমনই সহজ-সরল অংকের হিসাব! সত্যই কি তাই? দুই নেত্রী একত্রে বসলেই কি তাৎক্ষণিকভাবে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে?
এই মুহূর্তে দুই নেত্রী এক টেবিলে বসলে কী হতে পারে? তাদের দু’জনের কেউই কি নির্বাচনে হারতে রাজি আছেন? হেরে গেলে খুশি মনে বিরোধী দলের আসনে বসতে রাজি আছেন? তৃতীয় কোন দল যদি নির্বাচনে জয়ী হয়, সেটা কি সহজভাবে মেনে নিতে পারবেন? কারণ, পরাজয় মেনে নেয়ার মানসিক প্র¯‘তি ছাড়া বিবদমান পক্ষের এক টেবিলে বসা কোনই অর্থ বহন করে না। 
এক টেবিলে বসলেই বা কী হবে? আলোচনার টেবিলে বসে কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে, সেটাই তো ¯ি’র করা যা”েছ না। একপক্ষ বলছে, ‘দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। হবেই।’ অপরপক্ষ বলছে, ‘তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া কোন নির্বাচন নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোন ধরনের হবে, সেটা নিয়েই কেবল আলোচনা হতে পারে।’ অর্থাৎ উভয়পক্ষই শর্ত দি”েছ। আবার উভয়পক্ষই বলছে, আলোচনায় কোন ‘পূর্বশর্ত’ দেয়া যাবে না!
উভয়পক্ষই ধনুর্ভঙ্গ পণ করে বসে আছেÑ ‘বিচার মানি, তবে তালগাছটা আমার’।
রাজনীতি যদি নীতি-আদর্শ-কর্মসূচিকে ঘিরে আবর্তিত হয়, তাহলে মীমাংসায় পৌঁছানোর সুযোগ থাকে। কিছুটা ছাড় দিয়ে, দু’পক্ষের অব¯’ানে কিছু কাটছাঁট করে একটা যৌথ সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব হতে পারে। কিš‘ রাজনীতি যখন কেবলই ক্ষমতায় আরোহণ বা ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রতিযোগিতায় সীমাবদ্ধ থাকে, নীতি-আদর্শ-কর্মসূচি কিংবা জাতীয় স্বার্থ যেখানে একেবারেই গৌণ, তখন সমাধানের কোন সূত্র থাকে না। ‘তালগাছ’ যখন একটাই, তখন সমঝোতার সুযোগ কোথায়?
এ অব¯’ায় এই দু’পক্ষের মধ্যে কেবল একটাই সমঝোতা হতে পারে। তারা আপসে ঠিক করে নিতে পারেন কে কখন তালগাছের মালিকানায় থাকবেন। একবার ‘ইনি’ সিংহাসনে বসবেন, আরেকবার ‘উনি’। শিশুপার্কে নাগরদোলায় ওঠানামার মতো। উপরে উঠলে নেমে আসতেই হবে। অপরপক্ষ তখন উপরে উঠবে। নেমে এলে কঠিন মাটির আঘাত। তারপর আবার উপরে। তখন অপরপক্ষ ধরাশায়ী। এরকম একটা ¯’ায়ী সমঝোতা হয়ে গেলে জাতি হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে পারে। 
কিš‘, এটাই কি চলতে থাকবে অনাদিকাল? এটাই কি গণতন্ত্র? দুই নেত্রী, তাদের দুই পরিবার এবং তাদের ঘিরে থাকা কিছু স্তাবক ও পূজারী পালাক্রমে ক্ষমতায় পরাক্রম দেখিয়ে যাবেন, পালাক্রমে প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করবেন। এটাই কি এই হতভাগ্য দেশের নিয়তি? যারা দুই নেত্রীকে টেবিলে বসানোর জন্য নিত্যদিন দুই নেত্রীর কাছেই দরখাস্ত পেশ করে চলেছেন, তারা কি এই নিয়তিকেই চিরায়ত রাখতে চান?
আজকাল বিদেশীরাও এই একই প্রেসক্রিপশন নিয়ে হাজির হ”েছন। তাদের অবশ্য বাংলাদেশের ভালো-মন্দ নিয়ে মাথাব্যথা নেই। সবারই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন এজেন্ডা। এই দুই নেত্রীকে তারা ভালোভাবে জানেন। উভয়পক্ষে তাদের আ¯’াভাজনরাও আছেন। অতএব এই দুয়ের যে কেউ এ দেশের ভাগ্যবিধাতা হলে তারা চেনা পথে হাঁটতে পারেন। এই দুয়ের বাইরে যেতে তারাও স্বা”ছন্দ্যবোধ করেন না। 
দুই.
২০০৭ সালে জর“রি অব¯’া জারি হওয়ার পর তথাকথিত ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা নিয়ে কানাঘুষা চলেছে। এর উৎপত্তি কোথায় জানি না, কিš‘ তার বিরোধিতা করে তখনকার ক্ষমতাবানদের বিরাগভাজন হয়েছিলাম। এই ‘ফর্মুলা’র মোদ্দা কথা ছিল আমাদের দুই নেত্রীকে কৌশলে রাজনীতি থেকেই সরিয়ে দেয়া। খালেদা জিয়াকে মাইনাস করে ‘নতুন বিএনপি’ গঠন করা এবং শেখ হাসিনাকে মাইনাস করে আওয়ামী লীগকে ‘পরিশুদ্ধ’ করা। ওই দু’দলের বাঘা বাঘা ব্যক্তিরাই সেদিন এই লক্ষ্যে প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়েছেন। 
আমার বরাবরের বিশ্বাস, দু’চারজন ব্যক্তিকে ‘মাইনাস’ করে রাজনীতি পরিশুদ্ধ করা যাবে না। কেবল দুই নেত্রীকে সরিয়ে দিলেই এই দুই দল পরিশুদ্ধ হয়ে যাবে, তেমন চিন্তা করা বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই নয়। 
সত্য বটে, দেশে এখন এক ধরনের দ্বিদলীয় রাজনৈতিক আবহ বিরাজ করছে। এই ব্যব¯’া অবধারিতরূপেই জš§ দিয়েছে ‘দ্বিদলীয় স্বৈরতন্ত্র’। সংসদীয় গণতন্ত্র পরিণত হয়েছে ‘সংসদীয় একনায়কত্বে’। (রাজনীতির ভোকাবুলারীতে আমরা এসব নতুন শব্দ সংযোজনের কৃতিত্ব দাবি করতে পারি)। এর মূল কারণ দল দুটির ভেতরে গণতন্ত্র নেই। 
যে দলে গণতন্ত্র নেই, সে দল ক্ষমতায় গিয়ে দেশকে গণতন্ত্র দেবে কিভাবে? গণতন্ত্র তো ফরমান জারি করে কায়েম করার বিষয় নয়। চর্চার বিষয়। রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক আচরণের মধ্য দিয়েই কেবল গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটতে পারে, অন্য কোনভাবে নয়। দলনেতা তার পছন্দের লোকজনকে দলের, এমনকি অঙ্গদল ও সহযোগী সংগঠনের, বিভিন্ন পদে মনোনয়ন দেবেন, মনোনীত ব্যক্তি ততক্ষণ ওই পদে বহাল থাকবেন যতক্ষণ তিনি নেতার কৃপাদৃষ্টিতে থাকেন। এটাই রাজনৈতিক কালচারে পরিণত হয়েছে। এ ধরনের ‘মনোনীত’ নেতারা সর্বক্ষণ চাকরি হারানোর ভয়ে তট¯’ থাকেন। 
১৯৮৫ সালে বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল সামনে রেখে এ রকম একটা উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছিল মনোনীত কমিটির পরিবর্তে নির্বাচিত কমিটি গঠনের। দলীয় গঠনতন্ত্রের সংশ্লিষ্ট কয়েকটি ধারা সংশোধনের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবে তৎকালীন পার্টি চেয়ারম্যান বিচারপতি সাত্তার এবং নির্বাহী চেয়ারম্যান খালেদা জিয়া দু’জনেই স্বাক্ষর দিয়েছিলেন। এর মধ্যে বিচারপতি সাত্তার মৃত্যুবরণ করায় খালেদা জিয়া ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হওয়ার পর দলের সিনিয়র নেতারা অধিকাংশ মনে করলেন নেত্রীর হাতে নিয়োগের ক্ষমতাটা থাকা তাদের জন্য নিরাপদ। প্রস্তাবটি আমাকে কাউন্সিল সভায় উত্থাপন করতে দেয়া হল না। এই সিদ্ধান্ত আমি মেনে নিতে পারিনি। অধিবেশন চলাকালেই আমি পার্টি চেয়ারম্যানকে এই মর্মে একটি চিঠি লিখলাম যে, আমি কোন ‘অনির্বাচিত’ কমিটিতে থাকতে চাই না, অতএব, তিনি যে নতুন কমিটি ‘মনোনীত’ করবেন, তাতে যেন আমার নাম না থাকে। চিঠিটা পার্টি চেয়ারপারসনের হাতে দিয়ে আমি সভা¯’ল ত্যাগ করি। তারপর ২০০১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে পার্টি ছেড়ে আসা পর্যন্ত পার্টির কোন দায়িত্বে থাকিনি। নেত্রীর এবং সহকর্মীদের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও। 
বিএনপির দল গঠন ও তার বিকাশে আমি প্রেসিডেন্ট জিয়ার সঙ্গে সার্বক্ষণিকভাবে কাজ করেছি। বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃত্যুর পরের দিনগুলোতে জীবনের ঝুঁকিও নিয়ে দলটির পুনর“জ্জীবনে সর্বশক্তি ব্যয় করেছি। আমি নিশ্চিত যে, নির্বাচিত কমিটির বিধান হলেও বিএনপিতে আর যাই হোক খালেদা জিয়ার অব¯’ান বরাবরই অটুট থাকত। কিš‘ অন্যদের ই”ছাতে সায় দিয়ে তিনি দলটিকে গণতন্ত্রের ধারায় নিয়ে যাওয়ার সুযোগটি হাত ছাড়া করেছেন। (দলের সিনিয়র নেতারা যারা সেদিন মনে করেছিলেন নেত্রীর হাতে তাদের পদ-পদবি ‘নিরাপদ’ থাকবে, তাদের অংক একেবারেই মেলেনি। দলটির এযাবৎকালের সব ক’জন মহাসচিবই নিজ নিজ ‘চাকরিচ্যুতি’র সংবাদ জেনেছেন সংবাদপত্রের মাধ্যমে!) 
সফল ও দায়িত্বশীল নেতৃত্বের পরীক্ষা হয় যোগ্য উত্তরসূরি গড়ে তোলা এবং নির্দিষ্ট সময় অন্তর দলের নেতৃত্বে পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে। একই ব্যক্তি দীর্ঘদিন একটি দলের চেয়ারম্যান থাকবেন কেন? পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক দেশেই নির্দিষ্ট সময় অন্তর দলের নেতৃত্বে পরিবর্তন হয়। ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, এমনকি ভারতকেও আমরা দৃষ্টান্ত হিসেবে নিতে পারি। দলের নেতৃত্ব ¯’ায়ীভাবে ব্যক্তি বিশেষের হাতে ¯ি’ত হয়ে গেলে, তিনি যতই যোগ্য কিংবা যতই জনপ্রিয় হোন না কেন, সেই দলে গণতন্ত্র থাকতে পারে না। এ ব্যব¯’ায় নতুন নেতৃত্বের বিকাশের সুযোগ থাকে না। একপর্যায়ে দলের সদস্যরা ব্যক্তিপূজায় অভ্যস্ত হয়ে যান। তখন পরিবারতন্ত্র অবধারিত হয়ে পড়ে। নেতার অবর্তমানে দলের হাল ধরার জন্য পরবর্তী ধাপে আর কেউ থাকে না। কর্মীরা তখন নেতার খড়মকেও পূজা দিতে শুর“ করে। অন্য কারও প্রতি তাদের আনুগত্য তৈরি হওয়ার সুযোগ থাকে না। এভাবেই রাজনীতি বন্ধ্যাদশায় নিপতিত হয়। আমাদের বড় দুই দল সে রকম একটা অব¯’ায় পৌঁছে গেছে।
তিন. 
গণতান্ত্রিক সমাজে নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং নতুন রাজনৈতিক শক্তির উšে§ষের পথ অবারিত থাকা প্রয়োজন। তবেই দেশের রাজনীতিতে ভারসাম্য আসতে পারে। জাতীয় রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে। কাউকে ‘মাইনাস’ করে নয়, সবাইকে নিয়েই গণতন্ত্রের চর্চা করতে হবে। সেই গণতন্ত্রের চর্র্চার জন্য প্রয়োজন রাজনীতি চর্চায় নিবেদিত রাজনীতিবিদের। প্রয়োজন রাজনৈতিক দলের। 
কেউ বলবেন, আমাদের দেশে কি রাজনৈতিক দলের কমতি আছে? কমতি নেই। শত্র“র মুখে ছাই দিয়ে শতাধিক দল তো হবেই। অন্য কোন দেশে এত রাজনৈতিক দল আছে বলে আমার জানা নেই। পাশাপাশি রাজনীতি চর্চায় আগ্রহী এবং খণ্ডকালীন সময়ের জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বাদ নিতে উৎসাহী ‘অরাজনীতিক’দের সংখ্যাও কম নয়। 
তবে আমাদের এই ‘অসংখ্য’ রাজনৈতিক দল বাস্তবে কাজীর গর“Ñ কেতাবে আছে গোয়ালে নেই। ৩৯টি নিবন্ধিত দলের প্রায় সব ক’টি এই জোট বা ওই জোটে যোগ দিয়ে দুই বড় দলের দোহার হয়েছে। তাদের আর আলাদাভাবে চেনার উপায় নেই। রাজনীতি চর্চা নয়, পরজীবী হয়ে মধুর চাকে যেটুকু ভাগ পাওয়া যায়, তার বাইরে কারও কোন লক্ষ্য আছে বলে মনে হয় না। 
সে জন্যই নতুন দলের ভাবনা সেদিন মাথায় ভর করেছিল। ২০০৭ সালের ১/১১-এর পরিবর্তন পরিকল্পিত ছিল বলে আমার কখনও মনে হয়নি। চলমান নৈরাজ্য সেরকম কোন একটা ব্যব¯’া অবধারিত করেছিল। সেদিন দেশের সর্বস্তরের মানুষ বিপুলভাবে সমর্থন জানিয়েছিল। সেই পরিবর্তনের নায়করা জাতিকে নতুন আশায় উজ্জীবিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে মানুষ সম্ভবত তাদের কাছ থেকে অনেক বেশি আশা করে ফেলেছিল। আমিও। 
ভেবেছিলাম এই সুযোগে একটা ভালো রাজনৈতিক দল দাঁড় করিয়ে ফেলব। নিজের চিন্তা-ভাবনাগুলো কাজে লাগাতে পারব। কিš‘ অল্পদিনেই স্বপ্নভঙ্গ। একদিকে ক্ষমতার শীর্ষে এরশাদীয় স্টাইলে ক্ষমতারোহণের চিন্তা-ভাবনা উঁকিঝুঁকি দি”েছ। অপরদিকে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগকে টুকরা করে সেসব টুকরা একত্র করে বাঘে-মোষে এক ঘাটে পানি খাওয়ানোর চেষ্টা। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতারা নিজেরাই যে প্রকল্পে উদ্যোগী। এই দুই ধারার টানাপোড়েনে বিব্রতকর অব¯’ায় পড়ে গেলাম। 
আমি বরাবরই নতুনের জয়গান গাওয়ার পক্ষে। কিš‘ রাজনীতির বিচারে পুরনো ধাঁচের মানুষ। গণতন্ত্রের পুরনো চিন্তাধারাতেই আটকে আছি। তাই কোন অগণতান্ত্রিক প্রয়াসে সায় দিতে পারি না। ফলে সেদিনের ক্ষমতাবানদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হতে বেশি সময় লাগেনি। আমার আশপাশে যারা বড়সড় ভিড় জমিয়ে তুলেছিলেন, তারাও অল্পদিনেই আমার ‘অদূরদর্শিতা ও অক্ষমতা’য় হতাশ হয়ে সরে গেলেন। আমি আমার পুরনো ধ্যান-ধারণার বৃত্তে আটকে থাকলাম। এখনও আছি। 
দেখা গেল কায়েমি স্বার্থের হাত অনেক লম্বা। যতটা অনুমান করতাম তার চেয়েও অনেক বেশি। অপরদিকে পরিবর্তনের প্রত্যাশা যারা জাগিয়েছিলেন, একটা ‘সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচনের আয়োজন করে দেশকে প্রকৃত জনপ্রতিনিধিদের সরকার উপহার দেয়ার কথা বলে বাহবা কুড়িয়েছেন, তারা নিজেরাই ‘পরিবর্তিত’ হয়ে গেলেন। যাদের তারা মাইনাস করতে চেয়েছেন, তাদের ‘প্লাস প্লাস’ করে রেখে গেলেন। বিদ্যমান রাজনৈতিক কালচার পরিবর্তনের যে সুযোগ এসেছিল, নতুন রাজনৈতিক শক্তির উšে§ষের যে ক্ষীণ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, তাকে অনেক দিনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত করে কায়েমি স্বার্থকে আরও বেশি কায়েমি হওয়ার পাকাপোক্ত ব্যব¯’া করে তারা নিজেদের পিঠ বাঁচালেন। 
ওই সময় কেউ কেউ আমাকে বলেছেন, “আপনি কেন ‘মাইনাস টু’-এর বিরোধিতা করছেন? ওটা হলে তো আপনাদের জন্য ভালো। না হলে তো আপনাদেরই মাইনাস হতে হবে।” 
সেদিন সে কথায় কান দেইনি। জবাবে নীতিকথা শুনিয়েছি। এখন মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করি, সেদিন কি ঠিক কাজটি করেছিলাম? 
চার. 
সাম্প্রতিককালে আবার সেই ‘মাইনাস’ তত্ত্ব আলোচনায় ফিরে এসেছে। রাস্তাঘাটে, মানুষের মুখে মুখে। হাসানুল হক ইনু অবশ্য ‘মাইনাস টু নয়, মাইনাস ওয়ান’ করতে চান। হুংকার দিয়েছেন, ওটা করেই ছাড়বেন। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে প্রতিপক্ষকে উদ্দেশ্য করে বারবার বলা হ”েছ, “মাইনাস টু’র কুশীলবরা আবার তৎপর”। বলা হ”েছ, “এত হৈ-হাঙ্গামা করছ কেন। ‘ওরা’ এলে তোমরাও রেহাই পাবে না”। এ যেন একপক্ষ অপরপক্ষকে বলা, “এসো দু’জনে মিলেমিশে ভাগাভাগি করি। বিড়াল এসে যেন পিঠা ভাগ করার সুযোগ না পায়।”
আসলে ‘মাইনাস’ কোন সমাধান হতে পারে না। ‘মাইনাস টু’ বা ‘মাইনাস ওয়ান’ কোনটাই নয়। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগে অনেক যোগ্য, দক্ষ ও নীতিবান মানুষ আছেন। দলে গণতন্ত্র থাকলে এমনিতেই নেতৃত্বের কাঠামো নিয়মিত বদলায়। জোর করে কিছু করতে হয় না। নমিনেশন কেনাবেচার ব্যবসা আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে যাবে। দুই দলের বাইরেও অনেক মানুষ আছে। ভালো বা মন্দ, বড় বা ছোট, সব রাজনৈতিক শক্তি পাশাপাশি থাকুক। দেশে মুক্ত গণতন্ত্রের চর্চা হোক। (‘সর্বহারা বিপ্লব’ ও ‘ইসলামী বিপ্লব’ পাশাপাশি বাজি পট্কা ফোটাতে থাকুক!)। জনগণ ভালো ও মন্দের পার্থক্য বুঝতে শিখুক। তাহলেই একটা মুক্তবুদ্ধির সমাজ গড়ে উঠবে। ব্যক্তিপূজা, পরিবারতন্ত্র, গোষ্ঠীতন্ত্রের শৃঙ্খল থেকে গণতন্ত্র মুক্তি পাবে। 
তবে অপরাজনীতির সংঘাতের সমাধান ‘সমরতন্ত্র’ নয়। সমরতন্ত্র কোন জাতির ভাগ্য বদলাতে পেরেছে দুনিয়ার ইতিহাসে তার দৃষ্টান্ত নেই। অপরদিকে গণতন্ত্রের লেবাসে ‘পার্লামেন্টারি একনায়কত্ব’ একটা জাতিকে কিভাবে দিন দিন রসাতলে নিতে পারে সে দৃষ্টান্ত আমাদের চোখের সামনেই রয়েছে। এ দুয়ের বাইরে যেতে হলে দায়িত্বশীল রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার বিকল্প নেই। দায়সারা ‘নাগরিক কমিটি’ নয়, পাঁচমিশালী নাগরিক কমিটি দেশ চালাতে পারে না। চাই সঠিকভাবে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনায় সক্ষম সুসংগঠিত রাজনৈতিক ‘দল’। চল্লিশ বছরেও যা আমরা গড়ে তুলতে পারিনি।
ড. বদিউল আলম মজুমদার লিখেছেন, ‘শুধু সমঝোতা নয়, সমাধানও চাই’। যারা নিত্যদিন কাগজে লিখে, টেলিভিশনে ঝড় তুলে পরিবর্তনের কথা বলেন, তাদের অনেকে রাজনীতির কথা উঠলেই বলেন, ‘আমি তো রাজনীতি করি না’। ভালো ছাত্র-ছাত্রীরা রাজনীতিতে আসে না। ভালো মানুষরা দূরে দাঁড়িয়ে গা বাঁচিয়ে দুর্বৃত্তকবলিত রাজনীতির উ”িছষ্টের জন্য হাপিত্যেশ করেন।
তত্ত্বকথার ফুলঝুরিতে কোন কাজ হবে না। এ যুগে রাষ্ট্রযন্ত্র কেবলই জটিল থেকে জটিলতর হয়ে চলেছে। রাজনীতিতে মেধা ও মননের ঘাটতি থাকলে এই রাষ্ট্রযন্ত্র বারংবার হোঁচট খাবে, খানাখন্দে পড়বে, সেটাই স্বাভাবিক। 
পুরনোকে প্রতি¯’াপন করতে হলে তার চেয়ে ভালো কিছু চাই। নইলে পরিবর্তন হবে অর্থহীন। শক্তি ও উদ্যমের অপচয়।
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী : রাজনীতিক, ভূরাজনীতি গবেষক 
ংযধঢ়ংযরহ@মঃষনফ.পড়স

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন