বৃহস্পতিবার, ৫ জুলাই, ২০১২

ওরা কেউ সন্ত্রাসী হয়ে জš§ায়নি, আমরাই বানিয়েছি




ড. ফে র দৌ স আ হ ম দ কো রে শী
কিছুকাল আগে একটি লেখায় ফেনীর জয়নাল হাজারীকে ‘আমার অতি প্রিয়’ উল্লেখ করায় অনেকে মনে করেছেন আমি বিদ্রƒপ করে এই কথাটা বলেছি। আমি মোটেই সেভাবে কথাটা বলিনি। হাজারী ষাটের দশকে আমার অতিশয় প্রিয়ভাজনদের একজন ছিল। তার অনেক অনাসৃষ্টি কাণ্ডের পরেও আমার মনোভাব সে রকমই আছে। পুরনো সহযোগীদের প্রতি কঠোর হতে না পারা মোটেই ভালো নয়। এজন্য অনেক খেসারত দিতে হয়।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়নাল হাজারী ছিল ফেনী-২ আসনে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী। ওই নির্বাচনে হাজারী আমাকে ‘পরাজিত’ করে সংসদে ঢুকেছে। কীভাবে এ ‘বিজয় অর্জিত’ হয়েছিল তার বিস্তারিত বিবরণ দিতে গেলে নিউজপ্রিন্টের বাজারে টান পড়বে।
আমি তখন বিএনপিতে ছিলাম। আমার নির্বাচনে দাঁড়ানোর কোন প্র¯‘তি ছিল না। দলের নেত্রী এবং অন্যদের অনুরোধে একেবারে শেষ মুহূর্তে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছি। মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার পরদিন জয়নাল হাজারীর সঙ্গে টেলিফোনে আমার কথা হয়। হাজারী আমার নির্বাচনে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তে অবাক হয়েছে। বলেছে, ‘আপনি নির্বাচনে দাঁড়াবেন আগে কেউ বলেননি। আপনার মনে আছে, একবার আপনি চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে আমি ফেনী রেলস্টেশনে ট্রেন থামিয়ে মানপত্র পড়েছিলাম। আমি নিজ হাতে লিখেছিলাম। এখনও সেটা আমার কাছে আছে। আমি তো এখনও গ্রামেই পড়ে আছি। এখন আপনি এখানে নির্বাচনে এসেছেন। ঠিক আছে, আমি আমার ছেলেদের বলে দিয়েছি, এবারে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন হবে।’ আমি বলেছি, ‘তোমার তো সংগঠন খুব ভালো। আমাদের দলের কী অব¯’া এখনও জানি না। দলের সিদ্ধান্তে আমাকে নির্বাচন করতে হ”েছ। দেখা হলে আবার কথা হবে।’
আর দেখা হয়নি। দু’দিন পর কয়েকজন সহকর্মীসহ আমার নিজ গ্রামে যাওয়ার পথে দাগনভূঁইয়া বাজারে পৌঁছলে পরিচিতজনরা গাড়ি থামিয়ে শুভে”ছা জানাতে থাকেন। আমি নির্বাচনে দাঁড়াব এটা তাদেরও মাথায় ছিল না। দেখতে দেখতে বেশ কিছু লোক জড়ো হয়ে গেল। আমি তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে বাজারের মাঝখানের বড় রাস্তা ধরে এগিয়ে যা”িছ। এমন সময় হঠাৎ বিকট শব্দে হতচকিত হয়ে উঠলাম। দেখলাম বিপরীত দিক থেকে আমাদের দিকে বৃষ্টির মতো বোমা ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে আসছে বিশ-পঁচিশজন যুবক। বোমার আঘাতে আমার সঙ্গীদের কয়েকজন রক্তাক্ত হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েছেন। ওই ‘সোনার ছেলেরা’ কাছে এসে অস্ত্র উঁচিয়ে আমাকে ঘিরে দাঁড়ায় এবং আমাদের এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলে। লোকজন ভয়ে আতংকে নিরাপদ দূরত্বে সরে গেছে। দু’-চারজন আমাকে সরে যাওয়ার জন্য টানাটানি করছে।
এটা যে হাজারীর পরিকল্পিত কর্মকাণ্ড ছিল তাতে সন্দেহের কোন কারণ নেই। উদ্দেশ্য ছিল অতি স্পষ্ট। মুখে মিষ্টি কথা বলে বাস্তবে এমন একটা পরি¯ি’তি সৃষ্টি করা যাতে আমি ভয় পেয়ে যাই এবং নিজে থেকেই নির্বাচন ছেড়ে ঢাকায় ফিরে আসি। আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারি এবং জীবন বাজি রেখে ওই দুর্বৃত্তদের মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নিই।
হাজারীর সম্ভবত স্মৃতিভ্রম ঘটেছিল। নইলে আমাকে তো তার খুব ভালো করেই জানার কথা। তার তো জানা থাকার কথা যে, মানুষ প্রজাতির মধ্যে এমন কিছু প্রাণীও আছে যাকে মিষ্টি কথায় ভোলানো যায়, প্রতারণা করে ঠকানো যায়, কিš‘ চাপ দিয়ে বাঁকানো যায় না।
কীভাবে ভোট ডাকাতি হয়
১৯৯৬ সালের ওই নির্বাচন আমাকে অমূল্য জ্ঞান উপহার দিয়েছে। জনসমর্থন থাকলেই হবে না, সেই জনগণকে ঠিকভাবে ভোট দেয়ার সুযোগও দিতে হবে; ঠিকভাবে ভোট দিলেও হবে না, সেই ভোট ঠিকভাবে গোনাগুনতি হ”েছ কিনা, ঠিকভাবে গোনার পর টেবুলেশনের সময় তাতে হেরফের ঘটানো হ”েছ কিনা, টেবুলেশনেরও পরে রিটার্নিং অফিসার ও প্রিসাইডিং অফিসার একজোট হয়ে ফলাফল পাল্টানোর কৌশল উদ্ভাবন করছেন কিনা, সব শেষে ভোটের ফলাফল ঘোষণার সময় নির্বাচন কমিশনের কর্তারা নাক গলা”েছন কিনাÑ প্রতিটি স্তরেই আছে কারচুপি, অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহারের নানা ফাঁকফোকর।
নির্বাচনী দুর্বৃত্তপনার যেসব কর্মকাণ্ড সেবারে চোখের সামনে দেখেছি তার কয়েকটি নিুরূপ : (ক) প্রিসাইডিং অফিসার এবং পুলিশের যোগসাজশে সশস্ত্র দুর্বৃত্ত দিয়ে ‘কেন্দ্র দখল’ করে অন্য দলের এজেন্ট ও সমর্থকদের বের করে দেয়া, অতঃপর ই”ছামতো সিল মেরে বাক্স ভর্তি করা, (খ) জোর করে প্রতিপক্ষের ভোটারদের হাত থেকে ব্যালটপত্র ছিনিয়ে নেয়া এবং তাতে নিজেদের মার্কায় সিল দিয়ে বাক্সে ফেলা, (গ) ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে যেতে বাধা দেয়া, বিশেষ করে যাওয়ার পথে মহিলাদের রিকশা উল্টে, শাড়ি টানাটানি করে বাধা দেয়া, (ঘ) আগের রাতে বোমা মেরে আতংক সৃষ্টি করা এবং মহিলাদের কেন্দ্রে যেতে বারণ করা, (ঙ) প্রিসাইডিং অফিসারকে বন্দুকের মুখে ভোটের হিসাব বদলাতে বাধ্য করা এবং সব শেষে (চ) প্রশাসনের উ”চ পর্যায়ের যোগসাজশে ব্যালটের হিসাবে রদবদল করে জনগণের রায় পাল্টে দেয়া, ইত্যাদি। (এসব ‘বৈপ্লবিক’ কর্মকাণ্ড কীভাবে সুচার“রূপে সম্পন্ন করা যায় সে ব্যাপারে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে ‘নির্বাচনে জেতার সহজ উপায়’ নামে একটি বই লেখার ই”ছা আমার অনেক দিনের।)
যারা নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করছেন, তাদের ব্যব¯’াপত্রে এসবের এলাজ থাকতে হবে। নইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, জাতীয় সরকার, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, সবই নস্যি।
আমাদের বর্তমান নির্বাচন ব্যব¯’ায় রিটার্নিং অফিসার (সাধারণত ডিসি) এবং প্রিসাইডিং অফিসারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তারা যে কোন অনিয়ম দেখেও না দেখার ভান করতে পারেন, আবার যে কোন কারণ দেখিয়ে একটি কেন্দ্রের নির্বাচন বাতিলও করে দিতে পারেন। এক্ষেত্রে তাদের সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনও পাল্টাতে পারে না। ভোট ডাকাতরা এ সুযোগটাই কাজে লাগায়। ক্ষমতাসীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় রিটার্নিং অফিসারের মাধ্যমে বিশেষ বিশেষ কেন্দ্রে নিজেদের পছন্দের লোকদের প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার নিযুক্ত করা হয়। কোথাও বা ঘুষ দিয়ে কিংবা ভয়-ভীতিতে তাদের বশ করা হয়। তারপর সব অনিয়মের মহোৎসব চলতে থাকে।
সেবারে উপরের সব পš’া কাজে লাগানোর পরও যখন নির্বাচনের ফলাফল নিজেদের দিকে নেয়া যা”িছল না তখন মাঝরাতে ভোট গণনা ও ফলাফল ঘোষণা বন্ধ করে দেয়া হয়। পরদিন ভোরে জানানো হয়, ‘গোলযোগের কারণে’ দুটি কেন্দ্রের নির্বাচন বাতিল করা হয়েছে, আবার নির্বাচন হবে। অতএব ফলাফল ¯’গিত, সাতদিন পর উপনির্বাচন। এরই মধ্যে প্রতিপক্ষ দল সরকার গঠন চূড়ান্ত করে ফেলেছে। সাতদিন পরের কাহিনী না বলাই ভালো।
ছাত্রজীবনে জয়নাল হাজারীকে জেলা পর্যায়ে ছাত্রলীগের একজন দক্ষ ও নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক হিসেবে পেয়েছিলাম। আমি ¯ি’র করেছিলাম হাজারী যদি নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে জয়ী হয় আমি তাকে অভিনন্দন জানিয়ে মাল্যভূষিত করব। আমার দুঃখ হয় যখন দেখি একজন স্বাধীনতাসংগ্রামী তথাকথিত ‘গডফাদার’ হিসেবে চিত্রিত হ”েছ এবং সেই পরিচয় সগর্বে ধারণ করছে। ‘গডফাদার’ শব্দটি তো সম্মানসূচক পরিচয় নয়।
দুই.
তবে আমি চির আশাবাদী মানুষ। এত কিছুর মধ্যেও আশা করছি, এই সন্ত্রাসনির্ভর রাজনীতির অবসান সম্ভব। ’৯৬-এর নির্বাচনে আমাকে সমর্থন জানাতে গিয়ে যারা সেদিন নানাভাবে নিগৃহীত হয়েছে (গাছের সঙ্গে বেঁধে কুকুর লেলিয়ে দেয়া, ড্রিল মেশিন চালিয়ে সারা শরীর ছিদ্র করে দেয়া, তলোয়ার দিয়ে মাথার ওপর কোপ দেয়াঃ ইত্যাদি), তাদের মনে প্রচণ্ড ক্ষোভ ছিল আমিও কেন এই সন্ত্রাসের বির“দ্ধে পাল্টা ব্যব¯’া নিলাম না। কেন ‘সমুচিত’ জবাব দিলাম না।
একপর্যায়ে সমর্থকদের চাপ এবং শুভাকাক্সক্ষীদের উপদেশ উপেক্ষা করা কঠিন হয়ে উঠেছিল। কিš‘ সন্ত্রাস দিয়েই সন্ত্রাস দমন করার কথা যারা বলেন, তাদের সঙ্গে আমি একমত হতে পারি না। ডাকাত মারতে গিয়ে নিজেই ডাকাত হয়ে যাওয়া আÍঘাতী হঠকারিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এতে সাময়িকভাবে অভীষ্ট সিদ্ধ হতে পারে, কিš‘ এ প্রক্রিয়ায় আÍার মৃত্যু ঘটে; যার পরিণতি কখনোই শুভ হতে পারে না।
তাছাড়া, এখানে-সেখানে দু’-চারজন সন্ত্রাসীর বির“দ্ধে ব্যব¯’া গ্রহণ করলেই কি সন্ত্রাস দূর হয়ে যাবে? প্রতিদিনই তো সন্ত্রাস-পাল্টা সন্ত্রাসে বহু সন্ত্রাসীর মৃত্যু ঘটছে। কিš‘ এক সন্ত্রাসীর মৃত্যু ঘটলে দু’দিনেই তার জায়গায় নতুন সন্ত্রাসীর আবির্ভাব ঘটছে। সন্ত্রাসের প্রকৃত উৎস চিহ্নিত করে তা নির্মূল না করা গেলে এ থেকে মুক্তির কোন পথ নেই।
সন্ত্রাসের উৎস কোথায়
সন্ত্রাসের উৎস কোথায়? আমার সাফ জবাব, সন্ত্রাসের উৎস হ”েছ আমাদের জাতীয় পর্যায়ের অসু¯’ রাজনীতি। প্রায় সব রাজনৈতিক দলই আজ সন্ত্রাসকে রাজনীতির জন্য অপরিহার্য মনে করছে। বিশেষ করে সব বড় দলের ভেতরেই আজ সন্ত্রাসী লালনের প্রতিযোগিতা চলছে। যেসব দলে সন্ত্রাসী নেই তারাও সন্ত্রাসী সংগ্রহের সুযোগ পেলে পিছিয়ে থাকে না। আমাদের জাতীয় নেতৃত্ব সন্ত্রাসের বির“দ্ধে বিস্ময়করভাবে নীরব। কারণ, সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষকতা আসছে দলের শীর্ষ থেকেই। কেবল নিজ দলের কেউ হতাহত হলেই তারা ক্ষণিকের জন্য সরব হয়ে ওঠেন। প্রতিপক্ষের কেউ সন্ত্রাসের শিকার হলে মনে মনে খুশি হন।
দেশব্যাপী আজকের এ অব্যাহত সন্ত্রাসের জন্য কোন ধরনের রাখঢাক না করেই আমি আমাদের দুই বড় দলকে দায়ী করছি। আমার কণ্ঠে যতটুকু জোর আছে তার সবটুকু দিয়েই বলতে পারি, আমাদের জাতীয় নেতৃত্ব, বিশেষ করে এ দুই দলের দুই নেত্রী যদি সন্ত্রাসের বির“দ্ধে সুস্পষ্ট অব¯’ান গ্রহণ করেন, তাহলে ক্যাম্পাসসহ সারাদেশ থেকে সন্ত্রাসের রাজত্ব তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে, কয়েক দিনের মধ্যে।
তিন.
একজন পাঠক আমাকে প্রশ্ন করেছেন, ‘আপনি সন্ত্রাসের বির“দ্ধে লেখেন। কিš‘ আপনিও কি ফেনীতে নিজ দলের সন্ত্রাসীদের মাথায় øেহের হাত বুলিয়ে দেননি?’
সত্যিই তো, আমিও কি মাঝেমধ্যে তা করিনি!
এক্ষেত্রে সেই পুরনো আপ্তবাক্য দিয়ে আÍপক্ষ সমর্থন করা যায়। বলতে পারি, ‘পাপকে ঘৃণা কর, পাপীকে নয়’।
তবে আমার মনে একটা প্রশ্ন : যাদের আমরা ‘সন্ত্রাসী’ বলছি তারা কোথা থেকে আসছে? আজ প্রত্যক্ষে পরোক্ষে আমাদের গোটা তর“ণ সমাজই সন্ত্রাসের শিকার। এরা আমাদেরই সন্তান। ভাই, বন্ধু, আÍীয়-স্বজনের ছেলেমেয়ে। ফেনীতে দেখেছি পনেরো-বিশ বছরের দরিদ্র পরিবারের ছেলেদেরই রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং কথিত ‘গডফাদার’রা ব্যবহার করছে। এদের লেখাপড়ার বালাই নেই। ভবিষ্যতের কোন পরিকল্পনা নেই। অনেকের মাথায় ঝুলছে নানাবিধ মামলা। পুলিশের তাড়া খেয়ে নিজ বাড়িতে থাকতে পারে না। কাজকর্মেও লাগতে পারে না। পলাতক জীবনে বেঁচে থাকার জন্য তাদের ‘বড় ভাই’/‘গডফাদার’দের অনুকম্পা, সমর্থন ও আর্থিক সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হয়। আওয়ামী লীগের হোক, বিএনপির হোক, শিবিরের হোকÑ সব দলের ‘ক্যাডার’দেরই এ কর“ণ অব¯’া। ক্যাম্পাসের ভেতরে যারা সন্ত্রাস করছে, তাদেরও নেতৃ¯’ানীয় দু’-চারজন ছাড়া বাদবাকিদের একই অব¯’া। সারাদেশে এ একই চিত্র।
রাজনৈতিক দলের এসব ‘ক্যাডার’ প্রায় সবাই কম-বেশি মাদকাসক্ত। কয়েক দিন আগে টিভিতে মাদকাসক্তদের নিয়ে একটা প্রতিবেদন দেখে আমার এই ছেলেদের কথা মনে পড়েছে। ফেনীতে সেবারে নির্বাচন করার সময় লক্ষ্য করেছি এদের কাউকে কিছু বেশি টাকা দিলে দু’-তিনদিন তার কোন খোঁজ পাওয়া যায় না। পরে জানতে পারি, কিছু টাকা হাতে পেলেই তারা ছুটে যায় কিছু বিশেষ জায়গায়। তারপর নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে সারা রাত। ঘোর কাটতে লাগে দু’-একদিন। আবার নেশা চাপলে তারা টাকার জন্য অ¯ি’র হয়ে পড়ে। তখন হেন কর্ম নেই যা তারা করতে পারে না বা করে না। কিছু রাজনৈতিক নেতা তাদের এই দুর্বলতার সুযোগ নেন। তাদের উৎসাহ জোগান। তাদের দিয়েই প্রতিপক্ষের ওপর নৃশংস হামলা চালানো হয়। ভোট চুরির মহোৎসব ঘটান। রাজনীতি ও দুর্বৃত্তপনায় কোন পার্থক্য থাকে না। সু¯’ ও স্বাভাবিক ছেলেদের দিয়ে এসব কাজ করানো সম্ভব নয়।
শেষ কথা
এ পরি¯ি’তির জন্য আমি নিজেকেও দায়ী মনে করি। আমাদের প্রজšে§র ব্যর্থতা ও অযোগ্যতার কারণেই রাজনীতি আজ এভাবে সন্ত্রাসনির্ভর হয়ে পড়েছে। ‘সন্ত্রাসের সক্ষমতা’কেই আমাদের তর“ণ প্রজš§ আজ রাজনীতির ‘সাফল্য’ মনে করছে।
‘ক্যাডার’ নামে অভিহিত রাজনৈতিক দলের এসব হতভাগ্য কর্মীর কেউই সন্ত্রাসী হয়ে জš§ায়নি। মায়ের কোলে সব শিশুই থাকে ফেরেশতার মতো পবিত্র। এরাও তাদের মায়ের কোলে নিষ্পাপই ছিল। আমাদের ভুল রাজনীতি, ব্যর্থ রাজনীতি তাদের ভুল পথে ঠেলে দিয়েছে। অর্থাৎ, আমরাই তাদের সন্ত্রাসী বানিয়েছি।
তাদের আবার সু¯’ করে তোলা, স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা, আমাদেরই দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ কারণেই সন্ত্রাসকে ঘৃণা করলেও সন্ত্রাসী কাজকর্মে লিপ্ত এই ছেলেদের আমি মানবিক দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করি। যে দলেরই হোক, তাদের সবার জন্য সত্যিই মায়া হয়।
আমার প্রীতিভাজন হাজারীর জন্যও।
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী : রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক
ংযধঢ়ংযরহ@মঃষনফ.পড়স 

বুধবার, ২০ জুন, ২০১২

বঙ্গবন্ধু, জিয়া ও মঞ্জুর হত্যা কি একসূত্রে গাঁথা?


ড. ফে র দৌ স আ হ ম দ কোরেশী
জনাব শামসুদ্দিন আহমদ, রাষ্ট্রপতির সাবেক সামরিক সচিব, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং জেনারেল মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ড বিষয়ে কিছু গুর“ত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরেছেন (‘মঞ্জুর কি সত্যই জিয়াকে হত্যা করেছিলেন?’, যুগান্তর, ৮ জুন, ২০১২)। 
তিনি লিখেছেন,
‘জিয়া ও মঞ্জুর হত্যা ছিল একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল সেনাবাহিনীকে পর্যায়ক্রমে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনামুক্ত করা এবং একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত রাজনৈতিক শক্তির কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা। এ ষড়যন্ত্রের মূল হোতা দেশের স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ও তাদের বিদেশী পৃষ্ঠপোষক, যারা নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সেনাবাহিনীর পাকিস্তান ফেরত অফিসারদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে ঃ।’
কিছু প্রশ্ন গত ৩২ বছর ধরে আমার হƒৎপিণ্ডে রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে চলেছে। আমার মনের গহিনে বরাবরই কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দেয়, কেন জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হল? কেন মঞ্জুর এভাবে নিহত হলেন? কেন ১২-১৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে জিয়া হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দেয়া হল? তাদের মৃত্যুদণ্ড দিতে এত তড়িঘড়ি করা হল কেন? 
আমার কষ্ট অনেক গুণে বেড়ে যায় যখন মনে করি জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি, যে দলের পত্তন ও অগ্রযাত্রায় আমি আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময় এবং আমার দক্ষতা-সক্ষমতা সবটুুকু উজাড় করে দিয়েছিলাম, সেই দলটি ১০ বছর ক্ষমতায় থেকেও এসব প্রশ্নের মীমাংসার কোন উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। এমনকি জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়া সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার পরও এ বিষয়টি নিয়ে কোন উ”চবাচ্য করেননি। কেন? কেন?
(শেখ হাসিনাকে সাধুবাদ জানাতে হয় অন্তত এই জন্য যে, তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার সম্পন্ন করার কাজে তার দায়িত্ব পালন করেছেন।) 
প্রশ্নগুলো খুবই স্পর্শকাতর। জনাব শামসুদ্দিন আহমদ এতদিন পরে হলেও বিষয়টি সাহসের সঙ্গে আলোচনায় এনেছেন। সে জন্য তাকে অন্তর থেকে ধন্যবাদ জানা”িছ। তিনি সেই সময় সেনাবাহিনীতে গুর“ত্বপূর্ণ দায়িত্বে কর্মরত ছিলেন। অনেক কিছু তার জানা থাকার কথা, যা বাইরে থেকে যথাযথ জানা সম্ভব ছিল না। জাতির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের জন্য অতীতের অমীমাংসিত প্রশ্নাবলীর জবাব জাতির সামনে স্পষ্ট হওয়া একান্তই জর“রি। 
তার লেখাটি পড়ে ৩১ বছর আগেকার সেই মর্মান্তিক ঘটনাবলীর দৃশ্যপট আবার মানসপটে ভেসে উঠছে। আমার বরাবরের বিশ্বাস, মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটিত হলেই জিয়া হত্যারও একটা কূলকিনারা খুঁজে পাওয়া যাবে। 
কিছু স্মৃতি
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আমি তখন বিএনপির সংগঠন গড়ে তোলার কাজে লিপ্ত থেকে দলের চেয়ারম্যানের সঙ্গে প্রায় সার্বক্ষণিক যোগাযোগে থেকেছি। রাষ্ট্রপতি মূলত দলের কিছু সাংগঠনিক বিরোধ মেটানোর জন্যই সেবারে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন। অন্তত বাইরে সেভাবেই প্রকাশ ছিল। তার দু’দিন আগে গিয়েছিলেন সিলেট। সেখানেও তিনি দলের ভেতরের দুটি গ্র“পের বিবাদ সরেজমিন বুঝে ব্যব¯’া নিয়েছেন। সিলেট থেকে ফিরেই চট্টগ্রাম। 
যতদূর মনে পড়ে ২৮ মে বিকালের দিকে ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর রোডের পার্টি অফিসে গিয়ে নিচে রাষ্ট্রপতির গাড়িবহর দেখলাম। জানলাম প্রেসিডেন্ট দোতলায় তার র“মে বসেছেন। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছি, এমন সময় দুপ্দাপ্ করে তিনি উপর থেকে নেমে আসছেন। আমি সালাম জানিয়ে সিঁড়ির একপাশে সরে দাঁড়ালাম। রাষ্ট্রপতি একটু থেমে মুচকি হেসে আমার দিকে ঝুঁকে চাপা স্বরে বললেনÑ ‘চিড়িয়াগুলো ঠিক আছে তো?’ আমিও হেসে বললাম, ‘ঠিক আছে’। তিনি সিঁড়ির আরেক ধাপ নেমে পেছনে না ফিরেই বললেন, ‘প্রোগ্রাম ঠিক?’ আমি তখন তাকে অনুসরণ করে নেমে আসছি। পেছন থেকে বললাম, ‘সব ঠিক’। (এই ‘চিড়িয়া’ প্রসঙ্গ এখন থাক।)
প্রেসিডেন্ট নিচে নেমে গাড়িতে উঠলেন। আমরা তাকে বিদায় জানালাম। হায়, তখন কি জানতাম, এটাই শেষ দেখা! চারদিন পর ৩ জুন ফিরে এলো তার মৃতদেহ! 
চট্টগ্রামের বিএনপিতে তখন দু’গ্র“পে বেজায় দ্বন্দ্ব। এক গ্র“পের নেতা উপ-প্রধানমন্ত্রী জামাল উদ্দিন আহমদ। আরেক গ্র“পের নেতা মন্ত্রী সুলতান আহমদ। রাষ্ট্রপতি দুই গ্র“পকে নিয়ে বসবেন। সেই সঙ্গে তিনি তার অন্যান্য কাজও করবেন। ২৯ মে রাতে বসলেন বিএনপির জেলা নেতাদের নিয়ে। সঙ্গে ছিলেন দলের মহাসচিব ডা. বদর“দ্দোজা চৌধুরীসহ আরও কয়েকজন। রাষ্ট্রপতির উপ¯ি’তিতেই অনেক রাত পর্যন্ত দুই গ্র“পের বিবাদ-বিসম্ব^াদ চলেছে। সবাইকে বিদায় দিয়ে তিনি দোতলায় গেলেন। তারপর সেই মর্মান্তিক ঘটনা। যে ঘটনা দেশের ইতিহাসের গতিধারা আরেকবার বদলে দিল। 
রাষ্ট্রপতিকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার বিশদ বিবরণ এখন কারও অজানা নয়। পরবর্তী সময়ে ওই রাতের সার্কিট হাউস অভিযানে অংশগ্রহণকারীদের কারও কারও কাছ থেকে আমি তাদের অপারেশনের বিস্তারিত শুনেছি। শুর“ থেকে শেষ পর্যন্ত। কিভাবে, কোন প্রেক্ষাপটে ঘটনাটি ঘটেছে। তা থেকে আমার ধারণা হয় যে, মিশনটি ‘কিলার মিশন’ ছিল না। মিশনের একজন সদস্য অন্যদের অগোচরে ‘কিলার’ হিসেবে বিশেষ কোন ‘এসাইনমেন্ট’ নিয়ে ওই কাজটি করেছে। 
মঞ্জুর রাষ্ট্র পরিচালনায় সেনাবাহিনীর আরও প্রত্যক্ষ ভূমিকায় থাকার পক্ষে ছিলেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, তিনি অনেক দিন ধরেই জিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করছিলেন পার্লামেন্ট ও মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে ‘বিপ্লবী সরকার’ গঠন করার জন্য। জিয়াই যার নেতৃত্বে থাকবেন। জিয়া রাজি হ”িছলেন না। ‘অভিযান’কারীদের ভাষ্য অনুযায়ী তাদের উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রপতিকে ক্যান্টনমেন্টে যেতে বাধ্য করা এবং সেখানে মঞ্জুরের উপ¯ি’তিতে তাদের দাবি মতো সিদ্ধান্ত কার্যকর করা। জনাব শামসুদ্দিনও সে কথাই বলেছেন। আমি তার এই বয়ান বিশ্বাস করি। 
মঞ্জুর একজন দক্ষ ও চৌকস অফিসার ছিলেন এ কথা তার শত্র“রাও বলবেন। তার সঙ্গে আমার একবারই সামনাসামনি কথা হয়েছে, খুব সম্ভবত ১৯৭৭ সালে। দৈনিক দেশবাংলায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেশে অচিরেই নির্বাচন হতে পারে এরকম কিছু আভাস দেয়া হয়েছিল। লেখাটা তখনকার সেনাপতিদের কারও কারও পছন্দ হয়নি, কারণÑ নির্বাচনের চিন্তা তাদের মাথায় ছিল না। তাই সেনা সদর দফতরে আমার ডাক পড়ল। মঞ্জুর তখন সিজিএস। তিনি প্রতিবেদন সম্পর্কে সরাসরি কিছু না বলে নানা বিষয় নিয়ে কথা বললেন। সবশেষে বললেন, ‘ইলেকশন তো খুব সেন্সেটিভ ইস্যু। এ নিয়ে স্কুপ নিউজ না করাই ভালো’। আমি বললাম, ‘প্রতিবেদনটির শিরোনামে কিš‘ প্রশ্নবোধক চিহ্ন দেয়া আছে’। তিনি হেসে বললেন, ‘ওটা তো আপনাদের জার্নালিস্টিক কাভার’। ওই পর্যন্তই। এরপর তার সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার কোন সুযোগ আমার হয়নি। 
জিয়া সেনাবাহিনীতে শৃংখলা ফিরিয়ে এনেছিলেন। সেজন্য অনেক কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। সেজন্য অনেকে তার কঠোর সমালোচনা করে থাকেন। তবে সেনাবাহিনী এবং জাতীয় রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রে তিনি ঐক্য ও সমঝোতার ওপর বেশি জোর দিয়েছেন। এটাই সম্ভবত কাল হয়েছিল। দু’পক্ষই এতে নাখোশ ছিল। পাকিস্তান ফেরতদের একজনকে তিনি সেনাবাহিনীর প্রধান রেখে তাদের আ¯’া অর্জন করতে চেয়েছেন। তাদের খুশি করতে মঞ্জুরকে কমান্ড থেকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিš‘ তাতেও কাজ হল না। সম্ভবত তাকে তারই খেসারত দিতে হয়েছে। মঞ্জুরের চারপাশে তখন কিছু অনুগত ও অনুরক্ত জুনিয়র অফিসার জড়ো হয়েছিল। তারা মঞ্জুরের অবমূল্যায়নে ক্ষুব্ধ হবে সেটাই স্বাভাবিক। হতে পারে পুরো ব্যাপারটা তাদেরই অতি উৎসাহের পরিণতি। হতে পারে তারা মঞ্জুরের অজান্তেই কাজটি করেছে। হতে পারে এতে মঞ্জুরের পরোক্ষ সায় ছিল। তবে দেশের একপ্রান্তে চট্টগ্রামে বসে রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা যে অসম্ভব, সেটা অনুধাবনের ক্ষমতা মঞ্জুরের ছিল না, তা মনে করা মঞ্জুরের প্রতি চরম অবিচার হবে। এটা যদি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার লক্ষ্যে পরিকল্পিত ‘ক্যু’ হতো, তাহলে যে ধরনের প্র¯‘তি নেয়ার কথা তার বিন্দুমাত্র আভাসও কি ঘটনা পরবর্তীকালে দেখা গেছে? রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করা হয়েছে, তার লাশ পড়ে থাকল সার্কিট হাউসের বারান্দায়, সারা শহরে কোথাও ক্ষমতা দখলের কোন আলামত নেই। কোথাও সেনা মোতায়েন হয়নি। রেডিওতে মঞ্জুরের কণ্ঠ শোনা গেল অনেক বেলায়। পরিকল্পনাহীন অসংলগ্ন কথাবার্তা। ওটা স্পষ্টতই ক্ষমতা দখলকারী ‘ক্যু-দে-তা’র নায়কের কণ্ঠস্বর মনে হয়নি। 
তাহলে কার নির্দেশে সেদিন এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল?
শামসুদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা জিয়া ও মঞ্জুরের মধ্যে বিরাজমান বৈরিতাকে পুঁজি করে উভয়কে হত্যা করার পরিকল্পনা করে।’
কারা সেই ‘ষড়যন্ত্রকারী’?
সেই দিনগুলোতে দেশের ভেতরে জিয়া কাদের স্বার্থে আঘাত করেছেন? কারা তাদের স্বার্থ বিঘিœত হওয়ার আশংকায় তাকে সরিয়ে দেয়া অপরিহার্য মনে করেছে? 
রাষ্ট্রপতি জিয়া তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য শুর“ থেকেই ডান-বামের সংমিশ্রণ ঘটাতে চেষ্টা করেছেন। প্রথমে ‘জাগদল’ তারপর বিএনপির যাত্রা শুর“ হয়েছিল সেভাবেই। কিš‘ তার মৃত্যুর আগের দিনগুলোতে তার রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় কিছু মৌলিক পরিবর্তন আসতে শুর“ করেছিল। ডান বা বাম নয়, একটা সা”চা মধ্যপš’ী দল হিসেবে বিএনপিকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর কাজ শুর“ হয়েছিল। আর সেজন্য মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের ব্যক্তিদের দলে টেনে আনার জন্য তিনি বিশেষ আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন।
মন্ত্রিসভাও সেভাবে ঢেলে সাজানোর ব্যাপারে তিনি কিছু বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই যা কার্যকর হতো। প্রধানমন্ত্রীর কাছে কোন গুর“ত্বপূর্ণ ফাইল যা”েছ না বেশ কয়েক মাস। একজন নতুন প্রধানমন্ত্রী শিগগিরই শপথ নেবেন। এমন সব খবর তখন বাতাসে ভাসছে। এই পরিবর্তনে যাদের পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা, তারা নিশ্চুপ থাকবে কেন? 
একনায়ক এবং একনায়কের দল
রাষ্ট্র পরিচালনায় জিয়া ‘একনায়ক’ ছিলেন। এককভাবেই সিদ্ধান্ত নিতেন। যদিও সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তিনি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করতেন। সিদ্ধান্ত নিতেন নিজেই। আমাদের বর্তমানকালের ‘পার্লামেন্টারি একনায়ক’দের মতোই তিনি এক”ছত্র ক্ষমতা ভোগ করেছেন। তবে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে নিজের কোন বৈষয়িক স্বার্থ তার বিবেচনায় থাকত বলে তার শত্র“রাও বলতে পারবেন না। তার শাসনে ‘পরিবারতন্ত্রে’র ছায়ামাত্রও ছিল না। সেখানেই তিনি আজকের একনায়কদের চেয়ে ভিন্ন। তার রেখে যাওয়া দল থেকেও।
তবে নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার ব্যাপারে তিনি একনায়কের মতোই আচরণ করেছেন। রাজনীতিকদের বশে রাখতে সামরিক ছাউনি এবং সামরিক ছাউনিকে বশে রাখার জন্য বাইরের রাজনৈতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন। এক্ষেত্রে তার কোন সঙ্গী ছিল বলে আমার মনে হয় না। সেজন্যই তার মৃত্যুর পর তার এত জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও তার দলটি নোঙরবিহীন তরণীর মতো তলিয়ে যেতে বসেছিল। 
’৮১তে একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার এক বছরের মাথায় তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক শাসন জারি করা হয়। তারপর শুর“ হয় বিএনপিকে সরকারি দল বানানোর চক্রান্ত। দলের অধিকাংশ মন্ত্রী, এমপি ও সিনিয়র নেতারা তাতে সায় দিয়ে সামরিক শাসকের অনুগামী হয়েছেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কনভেনশন ডেকে সারাদেশের বিএনপি নেতাকর্মীদের জড়ো করে বিএনপির নেতৃত্ব কুক্ষিগত করার চেষ্টা হয়েছে। সেই দিনগুলোতে মাত্র গুটি কয়েকজন সেই ডুবন্ত তরণী ভাসমান রাখার জন্য প্রাণান্ত পরিশ্রম করেছি। অন্যান্য দলের বন্ধুরা সেই প্রচেষ্টা দেখে বলেছে, ‘কেন মিছেমিছি এত পরিশ্রম করছ। দুনিয়ার কোথায়ও কি ডিক্টেটরের বিদায়ের পর তার দল টিকে থেকেছে?’ 
কথাটা ঠিক। কিš‘ ‘একনায়ক’ জিয়াউর রহমানের দল সে যাত্রায় রক্ষা পেয়েছে। শুধু দলের তর“ণ নেতাকর্মীদের অদম্য দৃঢ়তা এবং উৎসাহে। মন্ত্রী, এমপি ও সিনিয়র নেতাদের অধিকাংশের বিরোধিতা বা নিষ্ক্রিয়তা সত্ত্বেও। তবে ‘একনায়কের দল’ হিসেবে নয়, নতুন পরি¯ি’তিতে স্বৈরশাসনের বির“দ্ধে একটি লড়াকু দল হিসেবেই শুর“ হয়েছিল দলটির নবযাত্রা। সম্পূর্ণ নতুনভাবে। পরিণতি যাই হোক না কেন। 
শেষ কথা 
মঞ্জুরের হত্যার বিষয়ে বলতে গিয়ে শামসুদ্দিন আহমদ লিখেছেন, তাকে হত্যা করা হয়েছে ‘ঠাণ্ডা মাথায়। তার মাথায় ছিল একটিমাত্র গুলির চিহ্ন।’ যতদূর জানা যায়, মঞ্জুর তখন সম্পূর্ণরূপেই ঢাকার কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। তাই উপরের নির্দেশ ছাড়া এমন ঘটনা ঘটানোর কোন সুযোগ ওই সময় ছিল না। জিয়ার ‘হত্যাকারী’ হিসেবে তার তো ফাঁসি অবধারিতই ছিল। তাহলে তাকে সরিয়ে দেয়ার প্রয়োজন হল কেন? কে দিয়েছিল সেই নির্দেশ?
রাষ্ট্রপতি জিয়ার সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল তিনি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপসহীন ছিলেন। শক্তিমানদের কাছে যা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। বাইরের বন্ধুত্বের চেয়ে নিজ দেশের স্বার্থকে তিনি বড় করে দেখেছেন। ছোট দেশের শাসকের জন্য এর চেয়ে বড় ‘অযোগ্যতা’ আর কিছু নেই। এরকম রাষ্ট্রনেতাদের জীবনে সর্বত্রই দুর্ভাগ্য নেমে এসেছে। জিয়া তার ব্যতিক্রম হতে পারলেন না। এই দেশে আজ্ঞাবহ এবং অনুগত শাসক যাদের প্রয়োজন, তাদের জন্য তিনি কি বাধা হয়ে উঠেছিলেন?
আরেকটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন
আমার মনে আরেকটি প্রশ্ন : বঙ্গবন্ধুর হত্যাও কি একই সূত্রে গাঁথা? কারণ, রাজনৈতিক অব¯’ান ভিন্ন হলেও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু সম্ভবত আরও বেশি আপসহীন ছিলেন। 
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী : রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক
ংযধঢ়ংযরহ@মঃষনফ.পড়স 
বঙ্গবন্ধু, জিয়া ও মঞ্জুর হত্যা কি একসূত্রে গাঁথা?




ড. ফে র দৌ স আ হ ম দ কোরেশী
জনাব শামসুদ্দিন আহমদ, রাষ্ট্রপতির সাবেক সামরিক সচিব, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং জেনারেল মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ড বিষয়ে কিছু গুর“ত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরেছেন (‘মঞ্জুর কি সত্যই জিয়াকে হত্যা করেছিলেন?’, যুগান্তর, ৮ জুন, ২০১২)। 
তিনি লিখেছেন,
‘জিয়া ও মঞ্জুর হত্যা ছিল একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল সেনাবাহিনীকে পর্যায়ক্রমে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনামুক্ত করা এবং একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত রাজনৈতিক শক্তির কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা। এ ষড়যন্ত্রের মূল হোতা দেশের স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ও তাদের বিদেশী পৃষ্ঠপোষক, যারা নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সেনাবাহিনীর পাকিস্তান ফেরত অফিসারদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে ঃ।’
কিছু প্রশ্ন গত ৩২ বছর ধরে আমার হƒৎপিণ্ডে রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে চলেছে। আমার মনের গহিনে বরাবরই কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দেয়, কেন জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হল? কেন মঞ্জুর এভাবে নিহত হলেন? কেন ১২-১৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে জিয়া হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দেয়া হল? তাদের মৃত্যুদণ্ড দিতে এত তড়িঘড়ি করা হল কেন? 
আমার কষ্ট অনেক গুণে বেড়ে যায় যখন মনে করি জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি, যে দলের পত্তন ও অগ্রযাত্রায় আমি আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময় এবং আমার দক্ষতা-সক্ষমতা সবটুুকু উজাড় করে দিয়েছিলাম, সেই দলটি ১০ বছর ক্ষমতায় থেকেও এসব প্রশ্নের মীমাংসার কোন উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। এমনকি জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়া সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার পরও এ বিষয়টি নিয়ে কোন উ”চবাচ্য করেননি। কেন? কেন?
(শেখ হাসিনাকে সাধুবাদ জানাতে হয় অন্তত এই জন্য যে, তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার সম্পন্ন করার কাজে তার দায়িত্ব পালন করেছেন।) 
প্রশ্নগুলো খুবই স্পর্শকাতর। জনাব শামসুদ্দিন আহমদ এতদিন পরে হলেও বিষয়টি সাহসের সঙ্গে আলোচনায় এনেছেন। সে জন্য তাকে অন্তর থেকে ধন্যবাদ জানা”িছ। তিনি সেই সময় সেনাবাহিনীতে গুর“ত্বপূর্ণ দায়িত্বে কর্মরত ছিলেন। অনেক কিছু তার জানা থাকার কথা, যা বাইরে থেকে যথাযথ জানা সম্ভব ছিল না। জাতির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের জন্য অতীতের অমীমাংসিত প্রশ্নাবলীর জবাব জাতির সামনে স্পষ্ট হওয়া একান্তই জর“রি। 
তার লেখাটি পড়ে ৩১ বছর আগেকার সেই মর্মান্তিক ঘটনাবলীর দৃশ্যপট আবার মানসপটে ভেসে উঠছে। আমার বরাবরের বিশ্বাস, মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটিত হলেই জিয়া হত্যারও একটা কূলকিনারা খুঁজে পাওয়া যাবে। 
কিছু স্মৃতি
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আমি তখন বিএনপির সংগঠন গড়ে তোলার কাজে লিপ্ত থেকে দলের চেয়ারম্যানের সঙ্গে প্রায় সার্বক্ষণিক যোগাযোগে থেকেছি। রাষ্ট্রপতি মূলত দলের কিছু সাংগঠনিক বিরোধ মেটানোর জন্যই সেবারে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন। অন্তত বাইরে সেভাবেই প্রকাশ ছিল। তার দু’দিন আগে গিয়েছিলেন সিলেট। সেখানেও তিনি দলের ভেতরের দুটি গ্র“পের বিবাদ সরেজমিন বুঝে ব্যব¯’া নিয়েছেন। সিলেট থেকে ফিরেই চট্টগ্রাম। 
যতদূর মনে পড়ে ২৮ মে বিকালের দিকে ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর রোডের পার্টি অফিসে গিয়ে নিচে রাষ্ট্রপতির গাড়িবহর দেখলাম। জানলাম প্রেসিডেন্ট দোতলায় তার র“মে বসেছেন। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছি, এমন সময় দুপ্দাপ্ করে তিনি উপর থেকে নেমে আসছেন। আমি সালাম জানিয়ে সিঁড়ির একপাশে সরে দাঁড়ালাম। রাষ্ট্রপতি একটু থেমে মুচকি হেসে আমার দিকে ঝুঁকে চাপা স্বরে বললেনÑ ‘চিড়িয়াগুলো ঠিক আছে তো?’ আমিও হেসে বললাম, ‘ঠিক আছে’। তিনি সিঁড়ির আরেক ধাপ নেমে পেছনে না ফিরেই বললেন, ‘প্রোগ্রাম ঠিক?’ আমি তখন তাকে অনুসরণ করে নেমে আসছি। পেছন থেকে বললাম, ‘সব ঠিক’। (এই ‘চিড়িয়া’ প্রসঙ্গ এখন থাক।)
প্রেসিডেন্ট নিচে নেমে গাড়িতে উঠলেন। আমরা তাকে বিদায় জানালাম। হায়, তখন কি জানতাম, এটাই শেষ দেখা! চারদিন পর ৩ জুন ফিরে এলো তার মৃতদেহ! 
চট্টগ্রামের বিএনপিতে তখন দু’গ্র“পে বেজায় দ্বন্দ্ব। এক গ্র“পের নেতা উপ-প্রধানমন্ত্রী জামাল উদ্দিন আহমদ। আরেক গ্র“পের নেতা মন্ত্রী সুলতান আহমদ। রাষ্ট্রপতি দুই গ্র“পকে নিয়ে বসবেন। সেই সঙ্গে তিনি তার অন্যান্য কাজও করবেন। ২৯ মে রাতে বসলেন বিএনপির জেলা নেতাদের নিয়ে। সঙ্গে ছিলেন দলের মহাসচিব ডা. বদর“দ্দোজা চৌধুরীসহ আরও কয়েকজন। রাষ্ট্রপতির উপ¯ি’তিতেই অনেক রাত পর্যন্ত দুই গ্র“পের বিবাদ-বিসম্ব^াদ চলেছে। সবাইকে বিদায় দিয়ে তিনি দোতলায় গেলেন। তারপর সেই মর্মান্তিক ঘটনা। যে ঘটনা দেশের ইতিহাসের গতিধারা আরেকবার বদলে দিল। 
রাষ্ট্রপতিকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার বিশদ বিবরণ এখন কারও অজানা নয়। পরবর্তী সময়ে ওই রাতের সার্কিট হাউস অভিযানে অংশগ্রহণকারীদের কারও কারও কাছ থেকে আমি তাদের অপারেশনের বিস্তারিত শুনেছি। শুর“ থেকে শেষ পর্যন্ত। কিভাবে, কোন প্রেক্ষাপটে ঘটনাটি ঘটেছে। তা থেকে আমার ধারণা হয় যে, মিশনটি ‘কিলার মিশন’ ছিল না। মিশনের একজন সদস্য অন্যদের অগোচরে ‘কিলার’ হিসেবে বিশেষ কোন ‘এসাইনমেন্ট’ নিয়ে ওই কাজটি করেছে। 
মঞ্জুর রাষ্ট্র পরিচালনায় সেনাবাহিনীর আরও প্রত্যক্ষ ভূমিকায় থাকার পক্ষে ছিলেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, তিনি অনেক দিন ধরেই জিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করছিলেন পার্লামেন্ট ও মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে ‘বিপ্লবী সরকার’ গঠন করার জন্য। জিয়াই যার নেতৃত্বে থাকবেন। জিয়া রাজি হ”িছলেন না। ‘অভিযান’কারীদের ভাষ্য অনুযায়ী তাদের উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রপতিকে ক্যান্টনমেন্টে যেতে বাধ্য করা এবং সেখানে মঞ্জুরের উপ¯ি’তিতে তাদের দাবি মতো সিদ্ধান্ত কার্যকর করা। জনাব শামসুদ্দিনও সে কথাই বলেছেন। আমি তার এই বয়ান বিশ্বাস করি। 
মঞ্জুর একজন দক্ষ ও চৌকস অফিসার ছিলেন এ কথা তার শত্র“রাও বলবেন। তার সঙ্গে আমার একবারই সামনাসামনি কথা হয়েছে, খুব সম্ভবত ১৯৭৭ সালে। দৈনিক দেশবাংলায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেশে অচিরেই নির্বাচন হতে পারে এরকম কিছু আভাস দেয়া হয়েছিল। লেখাটা তখনকার সেনাপতিদের কারও কারও পছন্দ হয়নি, কারণÑ নির্বাচনের চিন্তা তাদের মাথায় ছিল না। তাই সেনা সদর দফতরে আমার ডাক পড়ল। মঞ্জুর তখন সিজিএস। তিনি প্রতিবেদন সম্পর্কে সরাসরি কিছু না বলে নানা বিষয় নিয়ে কথা বললেন। সবশেষে বললেন, ‘ইলেকশন তো খুব সেন্সেটিভ ইস্যু। এ নিয়ে স্কুপ নিউজ না করাই ভালো’। আমি বললাম, ‘প্রতিবেদনটির শিরোনামে কিš‘ প্রশ্নবোধক চিহ্ন দেয়া আছে’। তিনি হেসে বললেন, ‘ওটা তো আপনাদের জার্নালিস্টিক কাভার’। ওই পর্যন্তই। এরপর তার সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার কোন সুযোগ আমার হয়নি। 
জিয়া সেনাবাহিনীতে শৃংখলা ফিরিয়ে এনেছিলেন। সেজন্য অনেক কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। সেজন্য অনেকে তার কঠোর সমালোচনা করে থাকেন। তবে সেনাবাহিনী এবং জাতীয় রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রে তিনি ঐক্য ও সমঝোতার ওপর বেশি জোর দিয়েছেন। এটাই সম্ভবত কাল হয়েছিল। দু’পক্ষই এতে নাখোশ ছিল। পাকিস্তান ফেরতদের একজনকে তিনি সেনাবাহিনীর প্রধান রেখে তাদের আ¯’া অর্জন করতে চেয়েছেন। তাদের খুশি করতে মঞ্জুরকে কমান্ড থেকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিš‘ তাতেও কাজ হল না। সম্ভবত তাকে তারই খেসারত দিতে হয়েছে। মঞ্জুরের চারপাশে তখন কিছু অনুগত ও অনুরক্ত জুনিয়র অফিসার জড়ো হয়েছিল। তারা মঞ্জুরের অবমূল্যায়নে ক্ষুব্ধ হবে সেটাই স্বাভাবিক। হতে পারে পুরো ব্যাপারটা তাদেরই অতি উৎসাহের পরিণতি। হতে পারে তারা মঞ্জুরের অজান্তেই কাজটি করেছে। হতে পারে এতে মঞ্জুরের পরোক্ষ সায় ছিল। তবে দেশের একপ্রান্তে চট্টগ্রামে বসে রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা যে অসম্ভব, সেটা অনুধাবনের ক্ষমতা মঞ্জুরের ছিল না, তা মনে করা মঞ্জুরের প্রতি চরম অবিচার হবে। এটা যদি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার লক্ষ্যে পরিকল্পিত ‘ক্যু’ হতো, তাহলে যে ধরনের প্র¯‘তি নেয়ার কথা তার বিন্দুমাত্র আভাসও কি ঘটনা পরবর্তীকালে দেখা গেছে? রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করা হয়েছে, তার লাশ পড়ে থাকল সার্কিট হাউসের বারান্দায়, সারা শহরে কোথাও ক্ষমতা দখলের কোন আলামত নেই। কোথাও সেনা মোতায়েন হয়নি। রেডিওতে মঞ্জুরের কণ্ঠ শোনা গেল অনেক বেলায়। পরিকল্পনাহীন অসংলগ্ন কথাবার্তা। ওটা স্পষ্টতই ক্ষমতা দখলকারী ‘ক্যু-দে-তা’র নায়কের কণ্ঠস্বর মনে হয়নি। 
তাহলে কার নির্দেশে সেদিন এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল?
শামসুদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা জিয়া ও মঞ্জুরের মধ্যে বিরাজমান বৈরিতাকে পুঁজি করে উভয়কে হত্যা করার পরিকল্পনা করে।’
কারা সেই ‘ষড়যন্ত্রকারী’?
সেই দিনগুলোতে দেশের ভেতরে জিয়া কাদের স্বার্থে আঘাত করেছেন? কারা তাদের স্বার্থ বিঘিœত হওয়ার আশংকায় তাকে সরিয়ে দেয়া অপরিহার্য মনে করেছে? 
রাষ্ট্রপতি জিয়া তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য শুর“ থেকেই ডান-বামের সংমিশ্রণ ঘটাতে চেষ্টা করেছেন। প্রথমে ‘জাগদল’ তারপর বিএনপির যাত্রা শুর“ হয়েছিল সেভাবেই। কিš‘ তার মৃত্যুর আগের দিনগুলোতে তার রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় কিছু মৌলিক পরিবর্তন আসতে শুর“ করেছিল। ডান বা বাম নয়, একটা সা”চা মধ্যপš’ী দল হিসেবে বিএনপিকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর কাজ শুর“ হয়েছিল। আর সেজন্য মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের ব্যক্তিদের দলে টেনে আনার জন্য তিনি বিশেষ আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন।
মন্ত্রিসভাও সেভাবে ঢেলে সাজানোর ব্যাপারে তিনি কিছু বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই যা কার্যকর হতো। প্রধানমন্ত্রীর কাছে কোন গুর“ত্বপূর্ণ ফাইল যা”েছ না বেশ কয়েক মাস। একজন নতুন প্রধানমন্ত্রী শিগগিরই শপথ নেবেন। এমন সব খবর তখন বাতাসে ভাসছে। এই পরিবর্তনে যাদের পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা, তারা নিশ্চুপ থাকবে কেন? 
একনায়ক এবং একনায়কের দল
রাষ্ট্র পরিচালনায় জিয়া ‘একনায়ক’ ছিলেন। এককভাবেই সিদ্ধান্ত নিতেন। যদিও সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তিনি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করতেন। সিদ্ধান্ত নিতেন নিজেই। আমাদের বর্তমানকালের ‘পার্লামেন্টারি একনায়ক’দের মতোই তিনি এক”ছত্র ক্ষমতা ভোগ করেছেন। তবে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে নিজের কোন বৈষয়িক স্বার্থ তার বিবেচনায় থাকত বলে তার শত্র“রাও বলতে পারবেন না। তার শাসনে ‘পরিবারতন্ত্রে’র ছায়ামাত্রও ছিল না। সেখানেই তিনি আজকের একনায়কদের চেয়ে ভিন্ন। তার রেখে যাওয়া দল থেকেও।
তবে নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার ব্যাপারে তিনি একনায়কের মতোই আচরণ করেছেন। রাজনীতিকদের বশে রাখতে সামরিক ছাউনি এবং সামরিক ছাউনিকে বশে রাখার জন্য বাইরের রাজনৈতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন। এক্ষেত্রে তার কোন সঙ্গী ছিল বলে আমার মনে হয় না। সেজন্যই তার মৃত্যুর পর তার এত জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও তার দলটি নোঙরবিহীন তরণীর মতো তলিয়ে যেতে বসেছিল। 
’৮১তে একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার এক বছরের মাথায় তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক শাসন জারি করা হয়। তারপর শুর“ হয় বিএনপিকে সরকারি দল বানানোর চক্রান্ত। দলের অধিকাংশ মন্ত্রী, এমপি ও সিনিয়র নেতারা তাতে সায় দিয়ে সামরিক শাসকের অনুগামী হয়েছেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কনভেনশন ডেকে সারাদেশের বিএনপি নেতাকর্মীদের জড়ো করে বিএনপির নেতৃত্ব কুক্ষিগত করার চেষ্টা হয়েছে। সেই দিনগুলোতে মাত্র গুটি কয়েকজন সেই ডুবন্ত তরণী ভাসমান রাখার জন্য প্রাণান্ত পরিশ্রম করেছি। অন্যান্য দলের বন্ধুরা সেই প্রচেষ্টা দেখে বলেছে, ‘কেন মিছেমিছি এত পরিশ্রম করছ। দুনিয়ার কোথায়ও কি ডিক্টেটরের বিদায়ের পর তার দল টিকে থেকেছে?’ 
কথাটা ঠিক। কিš‘ ‘একনায়ক’ জিয়াউর রহমানের দল সে যাত্রায় রক্ষা পেয়েছে। শুধু দলের তর“ণ নেতাকর্মীদের অদম্য দৃঢ়তা এবং উৎসাহে। মন্ত্রী, এমপি ও সিনিয়র নেতাদের অধিকাংশের বিরোধিতা বা নিষ্ক্রিয়তা সত্ত্বেও। তবে ‘একনায়কের দল’ হিসেবে নয়, নতুন পরি¯ি’তিতে স্বৈরশাসনের বির“দ্ধে একটি লড়াকু দল হিসেবেই শুর“ হয়েছিল দলটির নবযাত্রা। সম্পূর্ণ নতুনভাবে। পরিণতি যাই হোক না কেন। 
শেষ কথা 
মঞ্জুরের হত্যার বিষয়ে বলতে গিয়ে শামসুদ্দিন আহমদ লিখেছেন, তাকে হত্যা করা হয়েছে ‘ঠাণ্ডা মাথায়। তার মাথায় ছিল একটিমাত্র গুলির চিহ্ন।’ যতদূর জানা যায়, মঞ্জুর তখন সম্পূর্ণরূপেই ঢাকার কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। তাই উপরের নির্দেশ ছাড়া এমন ঘটনা ঘটানোর কোন সুযোগ ওই সময় ছিল না। জিয়ার ‘হত্যাকারী’ হিসেবে তার তো ফাঁসি অবধারিতই ছিল। তাহলে তাকে সরিয়ে দেয়ার প্রয়োজন হল কেন? কে দিয়েছিল সেই নির্দেশ?
রাষ্ট্রপতি জিয়ার সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল তিনি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপসহীন ছিলেন। শক্তিমানদের কাছে যা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। বাইরের বন্ধুত্বের চেয়ে নিজ দেশের স্বার্থকে তিনি বড় করে দেখেছেন। ছোট দেশের শাসকের জন্য এর চেয়ে বড় ‘অযোগ্যতা’ আর কিছু নেই। এরকম রাষ্ট্রনেতাদের জীবনে সর্বত্রই দুর্ভাগ্য নেমে এসেছে। জিয়া তার ব্যতিক্রম হতে পারলেন না। এই দেশে আজ্ঞাবহ এবং অনুগত শাসক যাদের প্রয়োজন, তাদের জন্য তিনি কি বাধা হয়ে উঠেছিলেন?
আরেকটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন
আমার মনে আরেকটি প্রশ্ন : বঙ্গবন্ধুর হত্যাও কি একই সূত্রে গাঁথা? কারণ, রাজনৈতিক অব¯’ান ভিন্ন হলেও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু সম্ভবত আরও বেশি আপসহীন ছিলেন। 
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী : রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক
ংযধঢ়ংযরহ@মঃষনফ.পড়স 
বঙ্গবন্ধু, জিয়া ও মঞ্জুর হত্যা কি একসূত্রে গাঁথা?




ড. ফে র দৌ স আ হ ম দ কোরেশী
জনাব শামসুদ্দিন আহমদ, রাষ্ট্রপতির সাবেক সামরিক সচিব, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং জেনারেল মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ড বিষয়ে কিছু গুর“ত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরেছেন (‘মঞ্জুর কি সত্যই জিয়াকে হত্যা করেছিলেন?’, যুগান্তর, ৮ জুন, ২০১২)। 
তিনি লিখেছেন,
‘জিয়া ও মঞ্জুর হত্যা ছিল একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল সেনাবাহিনীকে পর্যায়ক্রমে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনামুক্ত করা এবং একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত রাজনৈতিক শক্তির কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা। এ ষড়যন্ত্রের মূল হোতা দেশের স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ও তাদের বিদেশী পৃষ্ঠপোষক, যারা নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সেনাবাহিনীর পাকিস্তান ফেরত অফিসারদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে ঃ।’
কিছু প্রশ্ন গত ৩২ বছর ধরে আমার হƒৎপিণ্ডে রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে চলেছে। আমার মনের গহিনে বরাবরই কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দেয়, কেন জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হল? কেন মঞ্জুর এভাবে নিহত হলেন? কেন ১২-১৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে জিয়া হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দেয়া হল? তাদের মৃত্যুদণ্ড দিতে এত তড়িঘড়ি করা হল কেন? 
আমার কষ্ট অনেক গুণে বেড়ে যায় যখন মনে করি জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি, যে দলের পত্তন ও অগ্রযাত্রায় আমি আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময় এবং আমার দক্ষতা-সক্ষমতা সবটুুকু উজাড় করে দিয়েছিলাম, সেই দলটি ১০ বছর ক্ষমতায় থেকেও এসব প্রশ্নের মীমাংসার কোন উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। এমনকি জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়া সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার পরও এ বিষয়টি নিয়ে কোন উ”চবাচ্য করেননি। কেন? কেন?
(শেখ হাসিনাকে সাধুবাদ জানাতে হয় অন্তত এই জন্য যে, তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার সম্পন্ন করার কাজে তার দায়িত্ব পালন করেছেন।) 
প্রশ্নগুলো খুবই স্পর্শকাতর। জনাব শামসুদ্দিন আহমদ এতদিন পরে হলেও বিষয়টি সাহসের সঙ্গে আলোচনায় এনেছেন। সে জন্য তাকে অন্তর থেকে ধন্যবাদ জানা”িছ। তিনি সেই সময় সেনাবাহিনীতে গুর“ত্বপূর্ণ দায়িত্বে কর্মরত ছিলেন। অনেক কিছু তার জানা থাকার কথা, যা বাইরে থেকে যথাযথ জানা সম্ভব ছিল না। জাতির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের জন্য অতীতের অমীমাংসিত প্রশ্নাবলীর জবাব জাতির সামনে স্পষ্ট হওয়া একান্তই জর“রি। 
তার লেখাটি পড়ে ৩১ বছর আগেকার সেই মর্মান্তিক ঘটনাবলীর দৃশ্যপট আবার মানসপটে ভেসে উঠছে। আমার বরাবরের বিশ্বাস, মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটিত হলেই জিয়া হত্যারও একটা কূলকিনারা খুঁজে পাওয়া যাবে। 
কিছু স্মৃতি
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আমি তখন বিএনপির সংগঠন গড়ে তোলার কাজে লিপ্ত থেকে দলের চেয়ারম্যানের সঙ্গে প্রায় সার্বক্ষণিক যোগাযোগে থেকেছি। রাষ্ট্রপতি মূলত দলের কিছু সাংগঠনিক বিরোধ মেটানোর জন্যই সেবারে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন। অন্তত বাইরে সেভাবেই প্রকাশ ছিল। তার দু’দিন আগে গিয়েছিলেন সিলেট। সেখানেও তিনি দলের ভেতরের দুটি গ্র“পের বিবাদ সরেজমিন বুঝে ব্যব¯’া নিয়েছেন। সিলেট থেকে ফিরেই চট্টগ্রাম। 
যতদূর মনে পড়ে ২৮ মে বিকালের দিকে ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর রোডের পার্টি অফিসে গিয়ে নিচে রাষ্ট্রপতির গাড়িবহর দেখলাম। জানলাম প্রেসিডেন্ট দোতলায় তার র“মে বসেছেন। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছি, এমন সময় দুপ্দাপ্ করে তিনি উপর থেকে নেমে আসছেন। আমি সালাম জানিয়ে সিঁড়ির একপাশে সরে দাঁড়ালাম। রাষ্ট্রপতি একটু থেমে মুচকি হেসে আমার দিকে ঝুঁকে চাপা স্বরে বললেনÑ ‘চিড়িয়াগুলো ঠিক আছে তো?’ আমিও হেসে বললাম, ‘ঠিক আছে’। তিনি সিঁড়ির আরেক ধাপ নেমে পেছনে না ফিরেই বললেন, ‘প্রোগ্রাম ঠিক?’ আমি তখন তাকে অনুসরণ করে নেমে আসছি। পেছন থেকে বললাম, ‘সব ঠিক’। (এই ‘চিড়িয়া’ প্রসঙ্গ এখন থাক।)
প্রেসিডেন্ট নিচে নেমে গাড়িতে উঠলেন। আমরা তাকে বিদায় জানালাম। হায়, তখন কি জানতাম, এটাই শেষ দেখা! চারদিন পর ৩ জুন ফিরে এলো তার মৃতদেহ! 
চট্টগ্রামের বিএনপিতে তখন দু’গ্র“পে বেজায় দ্বন্দ্ব। এক গ্র“পের নেতা উপ-প্রধানমন্ত্রী জামাল উদ্দিন আহমদ। আরেক গ্র“পের নেতা মন্ত্রী সুলতান আহমদ। রাষ্ট্রপতি দুই গ্র“পকে নিয়ে বসবেন। সেই সঙ্গে তিনি তার অন্যান্য কাজও করবেন। ২৯ মে রাতে বসলেন বিএনপির জেলা নেতাদের নিয়ে। সঙ্গে ছিলেন দলের মহাসচিব ডা. বদর“দ্দোজা চৌধুরীসহ আরও কয়েকজন। রাষ্ট্রপতির উপ¯ি’তিতেই অনেক রাত পর্যন্ত দুই গ্র“পের বিবাদ-বিসম্ব^াদ চলেছে। সবাইকে বিদায় দিয়ে তিনি দোতলায় গেলেন। তারপর সেই মর্মান্তিক ঘটনা। যে ঘটনা দেশের ইতিহাসের গতিধারা আরেকবার বদলে দিল। 
রাষ্ট্রপতিকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার বিশদ বিবরণ এখন কারও অজানা নয়। পরবর্তী সময়ে ওই রাতের সার্কিট হাউস অভিযানে অংশগ্রহণকারীদের কারও কারও কাছ থেকে আমি তাদের অপারেশনের বিস্তারিত শুনেছি। শুর“ থেকে শেষ পর্যন্ত। কিভাবে, কোন প্রেক্ষাপটে ঘটনাটি ঘটেছে। তা থেকে আমার ধারণা হয় যে, মিশনটি ‘কিলার মিশন’ ছিল না। মিশনের একজন সদস্য অন্যদের অগোচরে ‘কিলার’ হিসেবে বিশেষ কোন ‘এসাইনমেন্ট’ নিয়ে ওই কাজটি করেছে। 
মঞ্জুর রাষ্ট্র পরিচালনায় সেনাবাহিনীর আরও প্রত্যক্ষ ভূমিকায় থাকার পক্ষে ছিলেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, তিনি অনেক দিন ধরেই জিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করছিলেন পার্লামেন্ট ও মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে ‘বিপ্লবী সরকার’ গঠন করার জন্য। জিয়াই যার নেতৃত্বে থাকবেন। জিয়া রাজি হ”িছলেন না। ‘অভিযান’কারীদের ভাষ্য অনুযায়ী তাদের উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রপতিকে ক্যান্টনমেন্টে যেতে বাধ্য করা এবং সেখানে মঞ্জুরের উপ¯ি’তিতে তাদের দাবি মতো সিদ্ধান্ত কার্যকর করা। জনাব শামসুদ্দিনও সে কথাই বলেছেন। আমি তার এই বয়ান বিশ্বাস করি। 
মঞ্জুর একজন দক্ষ ও চৌকস অফিসার ছিলেন এ কথা তার শত্র“রাও বলবেন। তার সঙ্গে আমার একবারই সামনাসামনি কথা হয়েছে, খুব সম্ভবত ১৯৭৭ সালে। দৈনিক দেশবাংলায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেশে অচিরেই নির্বাচন হতে পারে এরকম কিছু আভাস দেয়া হয়েছিল। লেখাটা তখনকার সেনাপতিদের কারও কারও পছন্দ হয়নি, কারণÑ নির্বাচনের চিন্তা তাদের মাথায় ছিল না। তাই সেনা সদর দফতরে আমার ডাক পড়ল। মঞ্জুর তখন সিজিএস। তিনি প্রতিবেদন সম্পর্কে সরাসরি কিছু না বলে নানা বিষয় নিয়ে কথা বললেন। সবশেষে বললেন, ‘ইলেকশন তো খুব সেন্সেটিভ ইস্যু। এ নিয়ে স্কুপ নিউজ না করাই ভালো’। আমি বললাম, ‘প্রতিবেদনটির শিরোনামে কিš‘ প্রশ্নবোধক চিহ্ন দেয়া আছে’। তিনি হেসে বললেন, ‘ওটা তো আপনাদের জার্নালিস্টিক কাভার’। ওই পর্যন্তই। এরপর তার সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার কোন সুযোগ আমার হয়নি। 
জিয়া সেনাবাহিনীতে শৃংখলা ফিরিয়ে এনেছিলেন। সেজন্য অনেক কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। সেজন্য অনেকে তার কঠোর সমালোচনা করে থাকেন। তবে সেনাবাহিনী এবং জাতীয় রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রে তিনি ঐক্য ও সমঝোতার ওপর বেশি জোর দিয়েছেন। এটাই সম্ভবত কাল হয়েছিল। দু’পক্ষই এতে নাখোশ ছিল। পাকিস্তান ফেরতদের একজনকে তিনি সেনাবাহিনীর প্রধান রেখে তাদের আ¯’া অর্জন করতে চেয়েছেন। তাদের খুশি করতে মঞ্জুরকে কমান্ড থেকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিš‘ তাতেও কাজ হল না। সম্ভবত তাকে তারই খেসারত দিতে হয়েছে। মঞ্জুরের চারপাশে তখন কিছু অনুগত ও অনুরক্ত জুনিয়র অফিসার জড়ো হয়েছিল। তারা মঞ্জুরের অবমূল্যায়নে ক্ষুব্ধ হবে সেটাই স্বাভাবিক। হতে পারে পুরো ব্যাপারটা তাদেরই অতি উৎসাহের পরিণতি। হতে পারে তারা মঞ্জুরের অজান্তেই কাজটি করেছে। হতে পারে এতে মঞ্জুরের পরোক্ষ সায় ছিল। তবে দেশের একপ্রান্তে চট্টগ্রামে বসে রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা যে অসম্ভব, সেটা অনুধাবনের ক্ষমতা মঞ্জুরের ছিল না, তা মনে করা মঞ্জুরের প্রতি চরম অবিচার হবে। এটা যদি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার লক্ষ্যে পরিকল্পিত ‘ক্যু’ হতো, তাহলে যে ধরনের প্র¯‘তি নেয়ার কথা তার বিন্দুমাত্র আভাসও কি ঘটনা পরবর্তীকালে দেখা গেছে? রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করা হয়েছে, তার লাশ পড়ে থাকল সার্কিট হাউসের বারান্দায়, সারা শহরে কোথাও ক্ষমতা দখলের কোন আলামত নেই। কোথাও সেনা মোতায়েন হয়নি। রেডিওতে মঞ্জুরের কণ্ঠ শোনা গেল অনেক বেলায়। পরিকল্পনাহীন অসংলগ্ন কথাবার্তা। ওটা স্পষ্টতই ক্ষমতা দখলকারী ‘ক্যু-দে-তা’র নায়কের কণ্ঠস্বর মনে হয়নি। 
তাহলে কার নির্দেশে সেদিন এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল?
শামসুদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা জিয়া ও মঞ্জুরের মধ্যে বিরাজমান বৈরিতাকে পুঁজি করে উভয়কে হত্যা করার পরিকল্পনা করে।’
কারা সেই ‘ষড়যন্ত্রকারী’?
সেই দিনগুলোতে দেশের ভেতরে জিয়া কাদের স্বার্থে আঘাত করেছেন? কারা তাদের স্বার্থ বিঘিœত হওয়ার আশংকায় তাকে সরিয়ে দেয়া অপরিহার্য মনে করেছে? 
রাষ্ট্রপতি জিয়া তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য শুর“ থেকেই ডান-বামের সংমিশ্রণ ঘটাতে চেষ্টা করেছেন। প্রথমে ‘জাগদল’ তারপর বিএনপির যাত্রা শুর“ হয়েছিল সেভাবেই। কিš‘ তার মৃত্যুর আগের দিনগুলোতে তার রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় কিছু মৌলিক পরিবর্তন আসতে শুর“ করেছিল। ডান বা বাম নয়, একটা সা”চা মধ্যপš’ী দল হিসেবে বিএনপিকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর কাজ শুর“ হয়েছিল। আর সেজন্য মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের ব্যক্তিদের দলে টেনে আনার জন্য তিনি বিশেষ আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন।
মন্ত্রিসভাও সেভাবে ঢেলে সাজানোর ব্যাপারে তিনি কিছু বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই যা কার্যকর হতো। প্রধানমন্ত্রীর কাছে কোন গুর“ত্বপূর্ণ ফাইল যা”েছ না বেশ কয়েক মাস। একজন নতুন প্রধানমন্ত্রী শিগগিরই শপথ নেবেন। এমন সব খবর তখন বাতাসে ভাসছে। এই পরিবর্তনে যাদের পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা, তারা নিশ্চুপ থাকবে কেন? 
একনায়ক এবং একনায়কের দল
রাষ্ট্র পরিচালনায় জিয়া ‘একনায়ক’ ছিলেন। এককভাবেই সিদ্ধান্ত নিতেন। যদিও সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তিনি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করতেন। সিদ্ধান্ত নিতেন নিজেই। আমাদের বর্তমানকালের ‘পার্লামেন্টারি একনায়ক’দের মতোই তিনি এক”ছত্র ক্ষমতা ভোগ করেছেন। তবে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে নিজের কোন বৈষয়িক স্বার্থ তার বিবেচনায় থাকত বলে তার শত্র“রাও বলতে পারবেন না। তার শাসনে ‘পরিবারতন্ত্রে’র ছায়ামাত্রও ছিল না। সেখানেই তিনি আজকের একনায়কদের চেয়ে ভিন্ন। তার রেখে যাওয়া দল থেকেও।
তবে নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার ব্যাপারে তিনি একনায়কের মতোই আচরণ করেছেন। রাজনীতিকদের বশে রাখতে সামরিক ছাউনি এবং সামরিক ছাউনিকে বশে রাখার জন্য বাইরের রাজনৈতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন। এক্ষেত্রে তার কোন সঙ্গী ছিল বলে আমার মনে হয় না। সেজন্যই তার মৃত্যুর পর তার এত জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও তার দলটি নোঙরবিহীন তরণীর মতো তলিয়ে যেতে বসেছিল। 
’৮১তে একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার এক বছরের মাথায় তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক শাসন জারি করা হয়। তারপর শুর“ হয় বিএনপিকে সরকারি দল বানানোর চক্রান্ত। দলের অধিকাংশ মন্ত্রী, এমপি ও সিনিয়র নেতারা তাতে সায় দিয়ে সামরিক শাসকের অনুগামী হয়েছেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কনভেনশন ডেকে সারাদেশের বিএনপি নেতাকর্মীদের জড়ো করে বিএনপির নেতৃত্ব কুক্ষিগত করার চেষ্টা হয়েছে। সেই দিনগুলোতে মাত্র গুটি কয়েকজন সেই ডুবন্ত তরণী ভাসমান রাখার জন্য প্রাণান্ত পরিশ্রম করেছি। অন্যান্য দলের বন্ধুরা সেই প্রচেষ্টা দেখে বলেছে, ‘কেন মিছেমিছি এত পরিশ্রম করছ। দুনিয়ার কোথায়ও কি ডিক্টেটরের বিদায়ের পর তার দল টিকে থেকেছে?’ 
কথাটা ঠিক। কিš‘ ‘একনায়ক’ জিয়াউর রহমানের দল সে যাত্রায় রক্ষা পেয়েছে। শুধু দলের তর“ণ নেতাকর্মীদের অদম্য দৃঢ়তা এবং উৎসাহে। মন্ত্রী, এমপি ও সিনিয়র নেতাদের অধিকাংশের বিরোধিতা বা নিষ্ক্রিয়তা সত্ত্বেও। তবে ‘একনায়কের দল’ হিসেবে নয়, নতুন পরি¯ি’তিতে স্বৈরশাসনের বির“দ্ধে একটি লড়াকু দল হিসেবেই শুর“ হয়েছিল দলটির নবযাত্রা। সম্পূর্ণ নতুনভাবে। পরিণতি যাই হোক না কেন। 
শেষ কথা 
মঞ্জুরের হত্যার বিষয়ে বলতে গিয়ে শামসুদ্দিন আহমদ লিখেছেন, তাকে হত্যা করা হয়েছে ‘ঠাণ্ডা মাথায়। তার মাথায় ছিল একটিমাত্র গুলির চিহ্ন।’ যতদূর জানা যায়, মঞ্জুর তখন সম্পূর্ণরূপেই ঢাকার কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। তাই উপরের নির্দেশ ছাড়া এমন ঘটনা ঘটানোর কোন সুযোগ ওই সময় ছিল না। জিয়ার ‘হত্যাকারী’ হিসেবে তার তো ফাঁসি অবধারিতই ছিল। তাহলে তাকে সরিয়ে দেয়ার প্রয়োজন হল কেন? কে দিয়েছিল সেই নির্দেশ?
রাষ্ট্রপতি জিয়ার সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল তিনি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপসহীন ছিলেন। শক্তিমানদের কাছে যা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। বাইরের বন্ধুত্বের চেয়ে নিজ দেশের স্বার্থকে তিনি বড় করে দেখেছেন। ছোট দেশের শাসকের জন্য এর চেয়ে বড় ‘অযোগ্যতা’ আর কিছু নেই। এরকম রাষ্ট্রনেতাদের জীবনে সর্বত্রই দুর্ভাগ্য নেমে এসেছে। জিয়া তার ব্যতিক্রম হতে পারলেন না। এই দেশে আজ্ঞাবহ এবং অনুগত শাসক যাদের প্রয়োজন, তাদের জন্য তিনি কি বাধা হয়ে উঠেছিলেন?
আরেকটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন
আমার মনে আরেকটি প্রশ্ন : বঙ্গবন্ধুর হত্যাও কি একই সূত্রে গাঁথা? কারণ, রাজনৈতিক অব¯’ান ভিন্ন হলেও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু সম্ভবত আরও বেশি আপসহীন ছিলেন। 
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী : রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক
ংযধঢ়ংযরহ@মঃষনফ.পড়স 
বঙ্গবন্ধু, জিয়া ও মঞ্জুর হত্যা কি একসূত্রে গাঁথা?




ড. ফে র দৌ স আ হ ম দ কোরেশী
জনাব শামসুদ্দিন আহমদ, রাষ্ট্রপতির সাবেক সামরিক সচিব, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং জেনারেল মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ড বিষয়ে কিছু গুর“ত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরেছেন (‘মঞ্জুর কি সত্যই জিয়াকে হত্যা করেছিলেন?’, যুগান্তর, ৮ জুন, ২০১২)। 
তিনি লিখেছেন,
‘জিয়া ও মঞ্জুর হত্যা ছিল একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল সেনাবাহিনীকে পর্যায়ক্রমে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনামুক্ত করা এবং একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত রাজনৈতিক শক্তির কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা। এ ষড়যন্ত্রের মূল হোতা দেশের স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ও তাদের বিদেশী পৃষ্ঠপোষক, যারা নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সেনাবাহিনীর পাকিস্তান ফেরত অফিসারদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে ঃ।’
কিছু প্রশ্ন গত ৩২ বছর ধরে আমার হƒৎপিণ্ডে রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে চলেছে। আমার মনের গহিনে বরাবরই কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দেয়, কেন জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হল? কেন মঞ্জুর এভাবে নিহত হলেন? কেন ১২-১৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে জিয়া হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দেয়া হল? তাদের মৃত্যুদণ্ড দিতে এত তড়িঘড়ি করা হল কেন? 
আমার কষ্ট অনেক গুণে বেড়ে যায় যখন মনে করি জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি, যে দলের পত্তন ও অগ্রযাত্রায় আমি আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময় এবং আমার দক্ষতা-সক্ষমতা সবটুুকু উজাড় করে দিয়েছিলাম, সেই দলটি ১০ বছর ক্ষমতায় থেকেও এসব প্রশ্নের মীমাংসার কোন উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। এমনকি জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়া সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার পরও এ বিষয়টি নিয়ে কোন উ”চবাচ্য করেননি। কেন? কেন?
(শেখ হাসিনাকে সাধুবাদ জানাতে হয় অন্তত এই জন্য যে, তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার সম্পন্ন করার কাজে তার দায়িত্ব পালন করেছেন।) 
প্রশ্নগুলো খুবই স্পর্শকাতর। জনাব শামসুদ্দিন আহমদ এতদিন পরে হলেও বিষয়টি সাহসের সঙ্গে আলোচনায় এনেছেন। সে জন্য তাকে অন্তর থেকে ধন্যবাদ জানা”িছ। তিনি সেই সময় সেনাবাহিনীতে গুর“ত্বপূর্ণ দায়িত্বে কর্মরত ছিলেন। অনেক কিছু তার জানা থাকার কথা, যা বাইরে থেকে যথাযথ জানা সম্ভব ছিল না। জাতির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের জন্য অতীতের অমীমাংসিত প্রশ্নাবলীর জবাব জাতির সামনে স্পষ্ট হওয়া একান্তই জর“রি। 
তার লেখাটি পড়ে ৩১ বছর আগেকার সেই মর্মান্তিক ঘটনাবলীর দৃশ্যপট আবার মানসপটে ভেসে উঠছে। আমার বরাবরের বিশ্বাস, মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটিত হলেই জিয়া হত্যারও একটা কূলকিনারা খুঁজে পাওয়া যাবে। 
কিছু স্মৃতি
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আমি তখন বিএনপির সংগঠন গড়ে তোলার কাজে লিপ্ত থেকে দলের চেয়ারম্যানের সঙ্গে প্রায় সার্বক্ষণিক যোগাযোগে থেকেছি। রাষ্ট্রপতি মূলত দলের কিছু সাংগঠনিক বিরোধ মেটানোর জন্যই সেবারে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন। অন্তত বাইরে সেভাবেই প্রকাশ ছিল। তার দু’দিন আগে গিয়েছিলেন সিলেট। সেখানেও তিনি দলের ভেতরের দুটি গ্র“পের বিবাদ সরেজমিন বুঝে ব্যব¯’া নিয়েছেন। সিলেট থেকে ফিরেই চট্টগ্রাম। 
যতদূর মনে পড়ে ২৮ মে বিকালের দিকে ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর রোডের পার্টি অফিসে গিয়ে নিচে রাষ্ট্রপতির গাড়িবহর দেখলাম। জানলাম প্রেসিডেন্ট দোতলায় তার র“মে বসেছেন। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছি, এমন সময় দুপ্দাপ্ করে তিনি উপর থেকে নেমে আসছেন। আমি সালাম জানিয়ে সিঁড়ির একপাশে সরে দাঁড়ালাম। রাষ্ট্রপতি একটু থেমে মুচকি হেসে আমার দিকে ঝুঁকে চাপা স্বরে বললেনÑ ‘চিড়িয়াগুলো ঠিক আছে তো?’ আমিও হেসে বললাম, ‘ঠিক আছে’। তিনি সিঁড়ির আরেক ধাপ নেমে পেছনে না ফিরেই বললেন, ‘প্রোগ্রাম ঠিক?’ আমি তখন তাকে অনুসরণ করে নেমে আসছি। পেছন থেকে বললাম, ‘সব ঠিক’। (এই ‘চিড়িয়া’ প্রসঙ্গ এখন থাক।)
প্রেসিডেন্ট নিচে নেমে গাড়িতে উঠলেন। আমরা তাকে বিদায় জানালাম। হায়, তখন কি জানতাম, এটাই শেষ দেখা! চারদিন পর ৩ জুন ফিরে এলো তার মৃতদেহ! 
চট্টগ্রামের বিএনপিতে তখন দু’গ্র“পে বেজায় দ্বন্দ্ব। এক গ্র“পের নেতা উপ-প্রধানমন্ত্রী জামাল উদ্দিন আহমদ। আরেক গ্র“পের নেতা মন্ত্রী সুলতান আহমদ। রাষ্ট্রপতি দুই গ্র“পকে নিয়ে বসবেন। সেই সঙ্গে তিনি তার অন্যান্য কাজও করবেন। ২৯ মে রাতে বসলেন বিএনপির জেলা নেতাদের নিয়ে। সঙ্গে ছিলেন দলের মহাসচিব ডা. বদর“দ্দোজা চৌধুরীসহ আরও কয়েকজন। রাষ্ট্রপতির উপ¯ি’তিতেই অনেক রাত পর্যন্ত দুই গ্র“পের বিবাদ-বিসম্ব^াদ চলেছে। সবাইকে বিদায় দিয়ে তিনি দোতলায় গেলেন। তারপর সেই মর্মান্তিক ঘটনা। যে ঘটনা দেশের ইতিহাসের গতিধারা আরেকবার বদলে দিল। 
রাষ্ট্রপতিকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার বিশদ বিবরণ এখন কারও অজানা নয়। পরবর্তী সময়ে ওই রাতের সার্কিট হাউস অভিযানে অংশগ্রহণকারীদের কারও কারও কাছ থেকে আমি তাদের অপারেশনের বিস্তারিত শুনেছি। শুর“ থেকে শেষ পর্যন্ত। কিভাবে, কোন প্রেক্ষাপটে ঘটনাটি ঘটেছে। তা থেকে আমার ধারণা হয় যে, মিশনটি ‘কিলার মিশন’ ছিল না। মিশনের একজন সদস্য অন্যদের অগোচরে ‘কিলার’ হিসেবে বিশেষ কোন ‘এসাইনমেন্ট’ নিয়ে ওই কাজটি করেছে। 
মঞ্জুর রাষ্ট্র পরিচালনায় সেনাবাহিনীর আরও প্রত্যক্ষ ভূমিকায় থাকার পক্ষে ছিলেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, তিনি অনেক দিন ধরেই জিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করছিলেন পার্লামেন্ট ও মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে ‘বিপ্লবী সরকার’ গঠন করার জন্য। জিয়াই যার নেতৃত্বে থাকবেন। জিয়া রাজি হ”িছলেন না। ‘অভিযান’কারীদের ভাষ্য অনুযায়ী তাদের উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রপতিকে ক্যান্টনমেন্টে যেতে বাধ্য করা এবং সেখানে মঞ্জুরের উপ¯ি’তিতে তাদের দাবি মতো সিদ্ধান্ত কার্যকর করা। জনাব শামসুদ্দিনও সে কথাই বলেছেন। আমি তার এই বয়ান বিশ্বাস করি। 
মঞ্জুর একজন দক্ষ ও চৌকস অফিসার ছিলেন এ কথা তার শত্র“রাও বলবেন। তার সঙ্গে আমার একবারই সামনাসামনি কথা হয়েছে, খুব সম্ভবত ১৯৭৭ সালে। দৈনিক দেশবাংলায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেশে অচিরেই নির্বাচন হতে পারে এরকম কিছু আভাস দেয়া হয়েছিল। লেখাটা তখনকার সেনাপতিদের কারও কারও পছন্দ হয়নি, কারণÑ নির্বাচনের চিন্তা তাদের মাথায় ছিল না। তাই সেনা সদর দফতরে আমার ডাক পড়ল। মঞ্জুর তখন সিজিএস। তিনি প্রতিবেদন সম্পর্কে সরাসরি কিছু না বলে নানা বিষয় নিয়ে কথা বললেন। সবশেষে বললেন, ‘ইলেকশন তো খুব সেন্সেটিভ ইস্যু। এ নিয়ে স্কুপ নিউজ না করাই ভালো’। আমি বললাম, ‘প্রতিবেদনটির শিরোনামে কিš‘ প্রশ্নবোধক চিহ্ন দেয়া আছে’। তিনি হেসে বললেন, ‘ওটা তো আপনাদের জার্নালিস্টিক কাভার’। ওই পর্যন্তই। এরপর তার সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার কোন সুযোগ আমার হয়নি। 
জিয়া সেনাবাহিনীতে শৃংখলা ফিরিয়ে এনেছিলেন। সেজন্য অনেক কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। সেজন্য অনেকে তার কঠোর সমালোচনা করে থাকেন। তবে সেনাবাহিনী এবং জাতীয় রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রে তিনি ঐক্য ও সমঝোতার ওপর বেশি জোর দিয়েছেন। এটাই সম্ভবত কাল হয়েছিল। দু’পক্ষই এতে নাখোশ ছিল। পাকিস্তান ফেরতদের একজনকে তিনি সেনাবাহিনীর প্রধান রেখে তাদের আ¯’া অর্জন করতে চেয়েছেন। তাদের খুশি করতে মঞ্জুরকে কমান্ড থেকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিš‘ তাতেও কাজ হল না। সম্ভবত তাকে তারই খেসারত দিতে হয়েছে। মঞ্জুরের চারপাশে তখন কিছু অনুগত ও অনুরক্ত জুনিয়র অফিসার জড়ো হয়েছিল। তারা মঞ্জুরের অবমূল্যায়নে ক্ষুব্ধ হবে সেটাই স্বাভাবিক। হতে পারে পুরো ব্যাপারটা তাদেরই অতি উৎসাহের পরিণতি। হতে পারে তারা মঞ্জুরের অজান্তেই কাজটি করেছে। হতে পারে এতে মঞ্জুরের পরোক্ষ সায় ছিল। তবে দেশের একপ্রান্তে চট্টগ্রামে বসে রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা যে অসম্ভব, সেটা অনুধাবনের ক্ষমতা মঞ্জুরের ছিল না, তা মনে করা মঞ্জুরের প্রতি চরম অবিচার হবে। এটা যদি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার লক্ষ্যে পরিকল্পিত ‘ক্যু’ হতো, তাহলে যে ধরনের প্র¯‘তি নেয়ার কথা তার বিন্দুমাত্র আভাসও কি ঘটনা পরবর্তীকালে দেখা গেছে? রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করা হয়েছে, তার লাশ পড়ে থাকল সার্কিট হাউসের বারান্দায়, সারা শহরে কোথাও ক্ষমতা দখলের কোন আলামত নেই। কোথাও সেনা মোতায়েন হয়নি। রেডিওতে মঞ্জুরের কণ্ঠ শোনা গেল অনেক বেলায়। পরিকল্পনাহীন অসংলগ্ন কথাবার্তা। ওটা স্পষ্টতই ক্ষমতা দখলকারী ‘ক্যু-দে-তা’র নায়কের কণ্ঠস্বর মনে হয়নি। 
তাহলে কার নির্দেশে সেদিন এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল?
শামসুদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা জিয়া ও মঞ্জুরের মধ্যে বিরাজমান বৈরিতাকে পুঁজি করে উভয়কে হত্যা করার পরিকল্পনা করে।’
কারা সেই ‘ষড়যন্ত্রকারী’?
সেই দিনগুলোতে দেশের ভেতরে জিয়া কাদের স্বার্থে আঘাত করেছেন? কারা তাদের স্বার্থ বিঘিœত হওয়ার আশংকায় তাকে সরিয়ে দেয়া অপরিহার্য মনে করেছে? 
রাষ্ট্রপতি জিয়া তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য শুর“ থেকেই ডান-বামের সংমিশ্রণ ঘটাতে চেষ্টা করেছেন। প্রথমে ‘জাগদল’ তারপর বিএনপির যাত্রা শুর“ হয়েছিল সেভাবেই। কিš‘ তার মৃত্যুর আগের দিনগুলোতে তার রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় কিছু মৌলিক পরিবর্তন আসতে শুর“ করেছিল। ডান বা বাম নয়, একটা সা”চা মধ্যপš’ী দল হিসেবে বিএনপিকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর কাজ শুর“ হয়েছিল। আর সেজন্য মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের ব্যক্তিদের দলে টেনে আনার জন্য তিনি বিশেষ আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন।
মন্ত্রিসভাও সেভাবে ঢেলে সাজানোর ব্যাপারে তিনি কিছু বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই যা কার্যকর হতো। প্রধানমন্ত্রীর কাছে কোন গুর“ত্বপূর্ণ ফাইল যা”েছ না বেশ কয়েক মাস। একজন নতুন প্রধানমন্ত্রী শিগগিরই শপথ নেবেন। এমন সব খবর তখন বাতাসে ভাসছে। এই পরিবর্তনে যাদের পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা, তারা নিশ্চুপ থাকবে কেন? 
একনায়ক এবং একনায়কের দল
রাষ্ট্র পরিচালনায় জিয়া ‘একনায়ক’ ছিলেন। এককভাবেই সিদ্ধান্ত নিতেন। যদিও সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তিনি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করতেন। সিদ্ধান্ত নিতেন নিজেই। আমাদের বর্তমানকালের ‘পার্লামেন্টারি একনায়ক’দের মতোই তিনি এক”ছত্র ক্ষমতা ভোগ করেছেন। তবে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে নিজের কোন বৈষয়িক স্বার্থ তার বিবেচনায় থাকত বলে তার শত্র“রাও বলতে পারবেন না। তার শাসনে ‘পরিবারতন্ত্রে’র ছায়ামাত্রও ছিল না। সেখানেই তিনি আজকের একনায়কদের চেয়ে ভিন্ন। তার রেখে যাওয়া দল থেকেও।
তবে নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার ব্যাপারে তিনি একনায়কের মতোই আচরণ করেছেন। রাজনীতিকদের বশে রাখতে সামরিক ছাউনি এবং সামরিক ছাউনিকে বশে রাখার জন্য বাইরের রাজনৈতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন। এক্ষেত্রে তার কোন সঙ্গী ছিল বলে আমার মনে হয় না। সেজন্যই তার মৃত্যুর পর তার এত জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও তার দলটি নোঙরবিহীন তরণীর মতো তলিয়ে যেতে বসেছিল। 
’৮১তে একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার এক বছরের মাথায় তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক শাসন জারি করা হয়। তারপর শুর“ হয় বিএনপিকে সরকারি দল বানানোর চক্রান্ত। দলের অধিকাংশ মন্ত্রী, এমপি ও সিনিয়র নেতারা তাতে সায় দিয়ে সামরিক শাসকের অনুগামী হয়েছেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কনভেনশন ডেকে সারাদেশের বিএনপি নেতাকর্মীদের জড়ো করে বিএনপির নেতৃত্ব কুক্ষিগত করার চেষ্টা হয়েছে। সেই দিনগুলোতে মাত্র গুটি কয়েকজন সেই ডুবন্ত তরণী ভাসমান রাখার জন্য প্রাণান্ত পরিশ্রম করেছি। অন্যান্য দলের বন্ধুরা সেই প্রচেষ্টা দেখে বলেছে, ‘কেন মিছেমিছি এত পরিশ্রম করছ। দুনিয়ার কোথায়ও কি ডিক্টেটরের বিদায়ের পর তার দল টিকে থেকেছে?’ 
কথাটা ঠিক। কিš‘ ‘একনায়ক’ জিয়াউর রহমানের দল সে যাত্রায় রক্ষা পেয়েছে। শুধু দলের তর“ণ নেতাকর্মীদের অদম্য দৃঢ়তা এবং উৎসাহে। মন্ত্রী, এমপি ও সিনিয়র নেতাদের অধিকাংশের বিরোধিতা বা নিষ্ক্রিয়তা সত্ত্বেও। তবে ‘একনায়কের দল’ হিসেবে নয়, নতুন পরি¯ি’তিতে স্বৈরশাসনের বির“দ্ধে একটি লড়াকু দল হিসেবেই শুর“ হয়েছিল দলটির নবযাত্রা। সম্পূর্ণ নতুনভাবে। পরিণতি যাই হোক না কেন। 
শেষ কথা 
মঞ্জুরের হত্যার বিষয়ে বলতে গিয়ে শামসুদ্দিন আহমদ লিখেছেন, তাকে হত্যা করা হয়েছে ‘ঠাণ্ডা মাথায়। তার মাথায় ছিল একটিমাত্র গুলির চিহ্ন।’ যতদূর জানা যায়, মঞ্জুর তখন সম্পূর্ণরূপেই ঢাকার কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। তাই উপরের নির্দেশ ছাড়া এমন ঘটনা ঘটানোর কোন সুযোগ ওই সময় ছিল না। জিয়ার ‘হত্যাকারী’ হিসেবে তার তো ফাঁসি অবধারিতই ছিল। তাহলে তাকে সরিয়ে দেয়ার প্রয়োজন হল কেন? কে দিয়েছিল সেই নির্দেশ?
রাষ্ট্রপতি জিয়ার সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল তিনি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপসহীন ছিলেন। শক্তিমানদের কাছে যা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। বাইরের বন্ধুত্বের চেয়ে নিজ দেশের স্বার্থকে তিনি বড় করে দেখেছেন। ছোট দেশের শাসকের জন্য এর চেয়ে বড় ‘অযোগ্যতা’ আর কিছু নেই। এরকম রাষ্ট্রনেতাদের জীবনে সর্বত্রই দুর্ভাগ্য নেমে এসেছে। জিয়া তার ব্যতিক্রম হতে পারলেন না। এই দেশে আজ্ঞাবহ এবং অনুগত শাসক যাদের প্রয়োজন, তাদের জন্য তিনি কি বাধা হয়ে উঠেছিলেন?
আরেকটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন
আমার মনে আরেকটি প্রশ্ন : বঙ্গবন্ধুর হত্যাও কি একই সূত্রে গাঁথা? কারণ, রাজনৈতিক অব¯’ান ভিন্ন হলেও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু সম্ভবত আরও বেশি আপসহীন ছিলেন। 
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী : রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক
ংযধঢ়ংযরহ@মঃষনফ.পড়স 
বঙ্গবন্ধু, জিয়া ও মঞ্জুর হত্যা কি একসূত্রে গাঁথা?




ড. ফে র দৌ স আ হ ম দ কোরেশী
জনাব শামসুদ্দিন আহমদ, রাষ্ট্রপতির সাবেক সামরিক সচিব, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং জেনারেল মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ড বিষয়ে কিছু গুর“ত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরেছেন (‘মঞ্জুর কি সত্যই জিয়াকে হত্যা করেছিলেন?’, যুগান্তর, ৮ জুন, ২০১২)। 
তিনি লিখেছেন,
‘জিয়া ও মঞ্জুর হত্যা ছিল একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল সেনাবাহিনীকে পর্যায়ক্রমে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনামুক্ত করা এবং একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত রাজনৈতিক শক্তির কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা। এ ষড়যন্ত্রের মূল হোতা দেশের স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ও তাদের বিদেশী পৃষ্ঠপোষক, যারা নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সেনাবাহিনীর পাকিস্তান ফেরত অফিসারদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে ঃ।’
কিছু প্রশ্ন গত ৩২ বছর ধরে আমার হƒৎপিণ্ডে রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে চলেছে। আমার মনের গহিনে বরাবরই কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দেয়, কেন জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হল? কেন মঞ্জুর এভাবে নিহত হলেন? কেন ১২-১৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে জিয়া হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দেয়া হল? তাদের মৃত্যুদণ্ড দিতে এত তড়িঘড়ি করা হল কেন? 
আমার কষ্ট অনেক গুণে বেড়ে যায় যখন মনে করি জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি, যে দলের পত্তন ও অগ্রযাত্রায় আমি আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময় এবং আমার দক্ষতা-সক্ষমতা সবটুুকু উজাড় করে দিয়েছিলাম, সেই দলটি ১০ বছর ক্ষমতায় থেকেও এসব প্রশ্নের মীমাংসার কোন উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। এমনকি জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়া সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার পরও এ বিষয়টি নিয়ে কোন উ”চবাচ্য করেননি। কেন? কেন?
(শেখ হাসিনাকে সাধুবাদ জানাতে হয় অন্তত এই জন্য যে, তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার সম্পন্ন করার কাজে তার দায়িত্ব পালন করেছেন।) 
প্রশ্নগুলো খুবই স্পর্শকাতর। জনাব শামসুদ্দিন আহমদ এতদিন পরে হলেও বিষয়টি সাহসের সঙ্গে আলোচনায় এনেছেন। সে জন্য তাকে অন্তর থেকে ধন্যবাদ জানা”িছ। তিনি সেই সময় সেনাবাহিনীতে গুর“ত্বপূর্ণ দায়িত্বে কর্মরত ছিলেন। অনেক কিছু তার জানা থাকার কথা, যা বাইরে থেকে যথাযথ জানা সম্ভব ছিল না। জাতির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের জন্য অতীতের অমীমাংসিত প্রশ্নাবলীর জবাব জাতির সামনে স্পষ্ট হওয়া একান্তই জর“রি। 
তার লেখাটি পড়ে ৩১ বছর আগেকার সেই মর্মান্তিক ঘটনাবলীর দৃশ্যপট আবার মানসপটে ভেসে উঠছে। আমার বরাবরের বিশ্বাস, মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটিত হলেই জিয়া হত্যারও একটা কূলকিনারা খুঁজে পাওয়া যাবে। 
কিছু স্মৃতি
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আমি তখন বিএনপির সংগঠন গড়ে তোলার কাজে লিপ্ত থেকে দলের চেয়ারম্যানের সঙ্গে প্রায় সার্বক্ষণিক যোগাযোগে থেকেছি। রাষ্ট্রপতি মূলত দলের কিছু সাংগঠনিক বিরোধ মেটানোর জন্যই সেবারে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন। অন্তত বাইরে সেভাবেই প্রকাশ ছিল। তার দু’দিন আগে গিয়েছিলেন সিলেট। সেখানেও তিনি দলের ভেতরের দুটি গ্র“পের বিবাদ সরেজমিন বুঝে ব্যব¯’া নিয়েছেন। সিলেট থেকে ফিরেই চট্টগ্রাম। 
যতদূর মনে পড়ে ২৮ মে বিকালের দিকে ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর রোডের পার্টি অফিসে গিয়ে নিচে রাষ্ট্রপতির গাড়িবহর দেখলাম। জানলাম প্রেসিডেন্ট দোতলায় তার র“মে বসেছেন। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছি, এমন সময় দুপ্দাপ্ করে তিনি উপর থেকে নেমে আসছেন। আমি সালাম জানিয়ে সিঁড়ির একপাশে সরে দাঁড়ালাম। রাষ্ট্রপতি একটু থেমে মুচকি হেসে আমার দিকে ঝুঁকে চাপা স্বরে বললেনÑ ‘চিড়িয়াগুলো ঠিক আছে তো?’ আমিও হেসে বললাম, ‘ঠিক আছে’। তিনি সিঁড়ির আরেক ধাপ নেমে পেছনে না ফিরেই বললেন, ‘প্রোগ্রাম ঠিক?’ আমি তখন তাকে অনুসরণ করে নেমে আসছি। পেছন থেকে বললাম, ‘সব ঠিক’। (এই ‘চিড়িয়া’ প্রসঙ্গ এখন থাক।)
প্রেসিডেন্ট নিচে নেমে গাড়িতে উঠলেন। আমরা তাকে বিদায় জানালাম। হায়, তখন কি জানতাম, এটাই শেষ দেখা! চারদিন পর ৩ জুন ফিরে এলো তার মৃতদেহ! 
চট্টগ্রামের বিএনপিতে তখন দু’গ্র“পে বেজায় দ্বন্দ্ব। এক গ্র“পের নেতা উপ-প্রধানমন্ত্রী জামাল উদ্দিন আহমদ। আরেক গ্র“পের নেতা মন্ত্রী সুলতান আহমদ। রাষ্ট্রপতি দুই গ্র“পকে নিয়ে বসবেন। সেই সঙ্গে তিনি তার অন্যান্য কাজও করবেন। ২৯ মে রাতে বসলেন বিএনপির জেলা নেতাদের নিয়ে। সঙ্গে ছিলেন দলের মহাসচিব ডা. বদর“দ্দোজা চৌধুরীসহ আরও কয়েকজন। রাষ্ট্রপতির উপ¯ি’তিতেই অনেক রাত পর্যন্ত দুই গ্র“পের বিবাদ-বিসম্ব^াদ চলেছে। সবাইকে বিদায় দিয়ে তিনি দোতলায় গেলেন। তারপর সেই মর্মান্তিক ঘটনা। যে ঘটনা দেশের ইতিহাসের গতিধারা আরেকবার বদলে দিল। 
রাষ্ট্রপতিকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার বিশদ বিবরণ এখন কারও অজানা নয়। পরবর্তী সময়ে ওই রাতের সার্কিট হাউস অভিযানে অংশগ্রহণকারীদের কারও কারও কাছ থেকে আমি তাদের অপারেশনের বিস্তারিত শুনেছি। শুর“ থেকে শেষ পর্যন্ত। কিভাবে, কোন প্রেক্ষাপটে ঘটনাটি ঘটেছে। তা থেকে আমার ধারণা হয় যে, মিশনটি ‘কিলার মিশন’ ছিল না। মিশনের একজন সদস্য অন্যদের অগোচরে ‘কিলার’ হিসেবে বিশেষ কোন ‘এসাইনমেন্ট’ নিয়ে ওই কাজটি করেছে। 
মঞ্জুর রাষ্ট্র পরিচালনায় সেনাবাহিনীর আরও প্রত্যক্ষ ভূমিকায় থাকার পক্ষে ছিলেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, তিনি অনেক দিন ধরেই জিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করছিলেন পার্লামেন্ট ও মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে ‘বিপ্লবী সরকার’ গঠন করার জন্য। জিয়াই যার নেতৃত্বে থাকবেন। জিয়া রাজি হ”িছলেন না। ‘অভিযান’কারীদের ভাষ্য অনুযায়ী তাদের উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রপতিকে ক্যান্টনমেন্টে যেতে বাধ্য করা এবং সেখানে মঞ্জুরের উপ¯ি’তিতে তাদের দাবি মতো সিদ্ধান্ত কার্যকর করা। জনাব শামসুদ্দিনও সে কথাই বলেছেন। আমি তার এই বয়ান বিশ্বাস করি। 
মঞ্জুর একজন দক্ষ ও চৌকস অফিসার ছিলেন এ কথা তার শত্র“রাও বলবেন। তার সঙ্গে আমার একবারই সামনাসামনি কথা হয়েছে, খুব সম্ভবত ১৯৭৭ সালে। দৈনিক দেশবাংলায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেশে অচিরেই নির্বাচন হতে পারে এরকম কিছু আভাস দেয়া হয়েছিল। লেখাটা তখনকার সেনাপতিদের কারও কারও পছন্দ হয়নি, কারণÑ নির্বাচনের চিন্তা তাদের মাথায় ছিল না। তাই সেনা সদর দফতরে আমার ডাক পড়ল। মঞ্জুর তখন সিজিএস। তিনি প্রতিবেদন সম্পর্কে সরাসরি কিছু না বলে নানা বিষয় নিয়ে কথা বললেন। সবশেষে বললেন, ‘ইলেকশন তো খুব সেন্সেটিভ ইস্যু। এ নিয়ে স্কুপ নিউজ না করাই ভালো’। আমি বললাম, ‘প্রতিবেদনটির শিরোনামে কিš‘ প্রশ্নবোধক চিহ্ন দেয়া আছে’। তিনি হেসে বললেন, ‘ওটা তো আপনাদের জার্নালিস্টিক কাভার’। ওই পর্যন্তই। এরপর তার সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার কোন সুযোগ আমার হয়নি। 
জিয়া সেনাবাহিনীতে শৃংখলা ফিরিয়ে এনেছিলেন। সেজন্য অনেক কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। সেজন্য অনেকে তার কঠোর সমালোচনা করে থাকেন। তবে সেনাবাহিনী এবং জাতীয় রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রে তিনি ঐক্য ও সমঝোতার ওপর বেশি জোর দিয়েছেন। এটাই সম্ভবত কাল হয়েছিল। দু’পক্ষই এতে নাখোশ ছিল। পাকিস্তান ফেরতদের একজনকে তিনি সেনাবাহিনীর প্রধান রেখে তাদের আ¯’া অর্জন করতে চেয়েছেন। তাদের খুশি করতে মঞ্জুরকে কমান্ড থেকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিš‘ তাতেও কাজ হল না। সম্ভবত তাকে তারই খেসারত দিতে হয়েছে। মঞ্জুরের চারপাশে তখন কিছু অনুগত ও অনুরক্ত জুনিয়র অফিসার জড়ো হয়েছিল। তারা মঞ্জুরের অবমূল্যায়নে ক্ষুব্ধ হবে সেটাই স্বাভাবিক। হতে পারে পুরো ব্যাপারটা তাদেরই অতি উৎসাহের পরিণতি। হতে পারে তারা মঞ্জুরের অজান্তেই কাজটি করেছে। হতে পারে এতে মঞ্জুরের পরোক্ষ সায় ছিল। তবে দেশের একপ্রান্তে চট্টগ্রামে বসে রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা যে অসম্ভব, সেটা অনুধাবনের ক্ষমতা মঞ্জুরের ছিল না, তা মনে করা মঞ্জুরের প্রতি চরম অবিচার হবে। এটা যদি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার লক্ষ্যে পরিকল্পিত ‘ক্যু’ হতো, তাহলে যে ধরনের প্র¯‘তি নেয়ার কথা তার বিন্দুমাত্র আভাসও কি ঘটনা পরবর্তীকালে দেখা গেছে? রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করা হয়েছে, তার লাশ পড়ে থাকল সার্কিট হাউসের বারান্দায়, সারা শহরে কোথাও ক্ষমতা দখলের কোন আলামত নেই। কোথাও সেনা মোতায়েন হয়নি। রেডিওতে মঞ্জুরের কণ্ঠ শোনা গেল অনেক বেলায়। পরিকল্পনাহীন অসংলগ্ন কথাবার্তা। ওটা স্পষ্টতই ক্ষমতা দখলকারী ‘ক্যু-দে-তা’র নায়কের কণ্ঠস্বর মনে হয়নি। 
তাহলে কার নির্দেশে সেদিন এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল?
শামসুদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা জিয়া ও মঞ্জুরের মধ্যে বিরাজমান বৈরিতাকে পুঁজি করে উভয়কে হত্যা করার পরিকল্পনা করে।’
কারা সেই ‘ষড়যন্ত্রকারী’?
সেই দিনগুলোতে দেশের ভেতরে জিয়া কাদের স্বার্থে আঘাত করেছেন? কারা তাদের স্বার্থ বিঘিœত হওয়ার আশংকায় তাকে সরিয়ে দেয়া অপরিহার্য মনে করেছে? 
রাষ্ট্রপতি জিয়া তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য শুর“ থেকেই ডান-বামের সংমিশ্রণ ঘটাতে চেষ্টা করেছেন। প্রথমে ‘জাগদল’ তারপর বিএনপির যাত্রা শুর“ হয়েছিল সেভাবেই। কিš‘ তার মৃত্যুর আগের দিনগুলোতে তার রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় কিছু মৌলিক পরিবর্তন আসতে শুর“ করেছিল। ডান বা বাম নয়, একটা সা”চা মধ্যপš’ী দল হিসেবে বিএনপিকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর কাজ শুর“ হয়েছিল। আর সেজন্য মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের ব্যক্তিদের দলে টেনে আনার জন্য তিনি বিশেষ আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন।
মন্ত্রিসভাও সেভাবে ঢেলে সাজানোর ব্যাপারে তিনি কিছু বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই যা কার্যকর হতো। প্রধানমন্ত্রীর কাছে কোন গুর“ত্বপূর্ণ ফাইল যা”েছ না বেশ কয়েক মাস। একজন নতুন প্রধানমন্ত্রী শিগগিরই শপথ নেবেন। এমন সব খবর তখন বাতাসে ভাসছে। এই পরিবর্তনে যাদের পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা, তারা নিশ্চুপ থাকবে কেন? 
একনায়ক এবং একনায়কের দল
রাষ্ট্র পরিচালনায় জিয়া ‘একনায়ক’ ছিলেন। এককভাবেই সিদ্ধান্ত নিতেন। যদিও সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তিনি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করতেন। সিদ্ধান্ত নিতেন নিজেই। আমাদের বর্তমানকালের ‘পার্লামেন্টারি একনায়ক’দের মতোই তিনি এক”ছত্র ক্ষমতা ভোগ করেছেন। তবে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে নিজের কোন বৈষয়িক স্বার্থ তার বিবেচনায় থাকত বলে তার শত্র“রাও বলতে পারবেন না। তার শাসনে ‘পরিবারতন্ত্রে’র ছায়ামাত্রও ছিল না। সেখানেই তিনি আজকের একনায়কদের চেয়ে ভিন্ন। তার রেখে যাওয়া দল থেকেও।
তবে নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার ব্যাপারে তিনি একনায়কের মতোই আচরণ করেছেন। রাজনীতিকদের বশে রাখতে সামরিক ছাউনি এবং সামরিক ছাউনিকে বশে রাখার জন্য বাইরের রাজনৈতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন। এক্ষেত্রে তার কোন সঙ্গী ছিল বলে আমার মনে হয় না। সেজন্যই তার মৃত্যুর পর তার এত জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও তার দলটি নোঙরবিহীন তরণীর মতো তলিয়ে যেতে বসেছিল। 
’৮১তে একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার এক বছরের মাথায় তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক শাসন জারি করা হয়। তারপর শুর“ হয় বিএনপিকে সরকারি দল বানানোর চক্রান্ত। দলের অধিকাংশ মন্ত্রী, এমপি ও সিনিয়র নেতারা তাতে সায় দিয়ে সামরিক শাসকের অনুগামী হয়েছেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কনভেনশন ডেকে সারাদেশের বিএনপি নেতাকর্মীদের জড়ো করে বিএনপির নেতৃত্ব কুক্ষিগত করার চেষ্টা হয়েছে। সেই দিনগুলোতে মাত্র গুটি কয়েকজন সেই ডুবন্ত তরণী ভাসমান রাখার জন্য প্রাণান্ত পরিশ্রম করেছি। অন্যান্য দলের বন্ধুরা সেই প্রচেষ্টা দেখে বলেছে, ‘কেন মিছেমিছি এত পরিশ্রম করছ। দুনিয়ার কোথায়ও কি ডিক্টেটরের বিদায়ের পর তার দল টিকে থেকেছে?’ 
কথাটা ঠিক। কিš‘ ‘একনায়ক’ জিয়াউর রহমানের দল সে যাত্রায় রক্ষা পেয়েছে। শুধু দলের তর“ণ নেতাকর্মীদের অদম্য দৃঢ়তা এবং উৎসাহে। মন্ত্রী, এমপি ও সিনিয়র নেতাদের অধিকাংশের বিরোধিতা বা নিষ্ক্রিয়তা সত্ত্বেও। তবে ‘একনায়কের দল’ হিসেবে নয়, নতুন পরি¯ি’তিতে স্বৈরশাসনের বির“দ্ধে একটি লড়াকু দল হিসেবেই শুর“ হয়েছিল দলটির নবযাত্রা। সম্পূর্ণ নতুনভাবে। পরিণতি যাই হোক না কেন। 
শেষ কথা 
মঞ্জুরের হত্যার বিষয়ে বলতে গিয়ে শামসুদ্দিন আহমদ লিখেছেন, তাকে হত্যা করা হয়েছে ‘ঠাণ্ডা মাথায়। তার মাথায় ছিল একটিমাত্র গুলির চিহ্ন।’ যতদূর জানা যায়, মঞ্জুর তখন সম্পূর্ণরূপেই ঢাকার কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। তাই উপরের নির্দেশ ছাড়া এমন ঘটনা ঘটানোর কোন সুযোগ ওই সময় ছিল না। জিয়ার ‘হত্যাকারী’ হিসেবে তার তো ফাঁসি অবধারিতই ছিল। তাহলে তাকে সরিয়ে দেয়ার প্রয়োজন হল কেন? কে দিয়েছিল সেই নির্দেশ?
রাষ্ট্রপতি জিয়ার সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল তিনি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপসহীন ছিলেন। শক্তিমানদের কাছে যা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। বাইরের বন্ধুত্বের চেয়ে নিজ দেশের স্বার্থকে তিনি বড় করে দেখেছেন। ছোট দেশের শাসকের জন্য এর চেয়ে বড় ‘অযোগ্যতা’ আর কিছু নেই। এরকম রাষ্ট্রনেতাদের জীবনে সর্বত্রই দুর্ভাগ্য নেমে এসেছে। জিয়া তার ব্যতিক্রম হতে পারলেন না। এই দেশে আজ্ঞাবহ এবং অনুগত শাসক যাদের প্রয়োজন, তাদের জন্য তিনি কি বাধা হয়ে উঠেছিলেন?
আরেকটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন
আমার মনে আরেকটি প্রশ্ন : বঙ্গবন্ধুর হত্যাও কি একই সূত্রে গাঁথা? কারণ, রাজনৈতিক অব¯’ান ভিন্ন হলেও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু সম্ভবত আরও বেশি আপসহীন ছিলেন। 
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী : রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক
ংযধঢ়ংযরহ@মঃষনফ.পড়স 
বঙ্গবন্ধু, জিয়া ও মঞ্জুর হত্যা কি একসূত্রে গাঁথা?




ড. ফে র দৌ স আ হ ম দ কোরেশী
জনাব শামসুদ্দিন আহমদ, রাষ্ট্রপতির সাবেক সামরিক সচিব, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং জেনারেল মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ড বিষয়ে কিছু গুর“ত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরেছেন (‘মঞ্জুর কি সত্যই জিয়াকে হত্যা করেছিলেন?’, যুগান্তর, ৮ জুন, ২০১২)। 
তিনি লিখেছেন,
‘জিয়া ও মঞ্জুর হত্যা ছিল একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল সেনাবাহিনীকে পর্যায়ক্রমে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনামুক্ত করা এবং একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত রাজনৈতিক শক্তির কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা। এ ষড়যন্ত্রের মূল হোতা দেশের স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ও তাদের বিদেশী পৃষ্ঠপোষক, যারা নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সেনাবাহিনীর পাকিস্তান ফেরত অফিসারদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে ঃ।’
কিছু প্রশ্ন গত ৩২ বছর ধরে আমার হƒৎপিণ্ডে রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে চলেছে। আমার মনের গহিনে বরাবরই কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দেয়, কেন জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হল? কেন মঞ্জুর এভাবে নিহত হলেন? কেন ১২-১৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে জিয়া হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দেয়া হল? তাদের মৃত্যুদণ্ড দিতে এত তড়িঘড়ি করা হল কেন? 
আমার কষ্ট অনেক গুণে বেড়ে যায় যখন মনে করি জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি, যে দলের পত্তন ও অগ্রযাত্রায় আমি আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময় এবং আমার দক্ষতা-সক্ষমতা সবটুুকু উজাড় করে দিয়েছিলাম, সেই দলটি ১০ বছর ক্ষমতায় থেকেও এসব প্রশ্নের মীমাংসার কোন উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। এমনকি জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়া সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার পরও এ বিষয়টি নিয়ে কোন উ”চবাচ্য করেননি। কেন? কেন?
(শেখ হাসিনাকে সাধুবাদ জানাতে হয় অন্তত এই জন্য যে, তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার সম্পন্ন করার কাজে তার দায়িত্ব পালন করেছেন।) 
প্রশ্নগুলো খুবই স্পর্শকাতর। জনাব শামসুদ্দিন আহমদ এতদিন পরে হলেও বিষয়টি সাহসের সঙ্গে আলোচনায় এনেছেন। সে জন্য তাকে অন্তর থেকে ধন্যবাদ জানা”িছ। তিনি সেই সময় সেনাবাহিনীতে গুর“ত্বপূর্ণ দায়িত্বে কর্মরত ছিলেন। অনেক কিছু তার জানা থাকার কথা, যা বাইরে থেকে যথাযথ জানা সম্ভব ছিল না। জাতির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের জন্য অতীতের অমীমাংসিত প্রশ্নাবলীর জবাব জাতির সামনে স্পষ্ট হওয়া একান্তই জর“রি। 
তার লেখাটি পড়ে ৩১ বছর আগেকার সেই মর্মান্তিক ঘটনাবলীর দৃশ্যপট আবার মানসপটে ভেসে উঠছে। আমার বরাবরের বিশ্বাস, মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটিত হলেই জিয়া হত্যারও একটা কূলকিনারা খুঁজে পাওয়া যাবে। 
কিছু স্মৃতি
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আমি তখন বিএনপির সংগঠন গড়ে তোলার কাজে লিপ্ত থেকে দলের চেয়ারম্যানের সঙ্গে প্রায় সার্বক্ষণিক যোগাযোগে থেকেছি। রাষ্ট্রপতি মূলত দলের কিছু সাংগঠনিক বিরোধ মেটানোর জন্যই সেবারে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন। অন্তত বাইরে সেভাবেই প্রকাশ ছিল। তার দু’দিন আগে গিয়েছিলেন সিলেট। সেখানেও তিনি দলের ভেতরের দুটি গ্র“পের বিবাদ সরেজমিন বুঝে ব্যব¯’া নিয়েছেন। সিলেট থেকে ফিরেই চট্টগ্রাম। 
যতদূর মনে পড়ে ২৮ মে বিকালের দিকে ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর রোডের পার্টি অফিসে গিয়ে নিচে রাষ্ট্রপতির গাড়িবহর দেখলাম। জানলাম প্রেসিডেন্ট দোতলায় তার র“মে বসেছেন। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছি, এমন সময় দুপ্দাপ্ করে তিনি উপর থেকে নেমে আসছেন। আমি সালাম জানিয়ে সিঁড়ির একপাশে সরে দাঁড়ালাম। রাষ্ট্রপতি একটু থেমে মুচকি হেসে আমার দিকে ঝুঁকে চাপা স্বরে বললেনÑ ‘চিড়িয়াগুলো ঠিক আছে তো?’ আমিও হেসে বললাম, ‘ঠিক আছে’। তিনি সিঁড়ির আরেক ধাপ নেমে পেছনে না ফিরেই বললেন, ‘প্রোগ্রাম ঠিক?’ আমি তখন তাকে অনুসরণ করে নেমে আসছি। পেছন থেকে বললাম, ‘সব ঠিক’। (এই ‘চিড়িয়া’ প্রসঙ্গ এখন থাক।)
প্রেসিডেন্ট নিচে নেমে গাড়িতে উঠলেন। আমরা তাকে বিদায় জানালাম। হায়, তখন কি জানতাম, এটাই শেষ দেখা! চারদিন পর ৩ জুন ফিরে এলো তার মৃতদেহ! 
চট্টগ্রামের বিএনপিতে তখন দু’গ্র“পে বেজায় দ্বন্দ্ব। এক গ্র“পের নেতা উপ-প্রধানমন্ত্রী জামাল উদ্দিন আহমদ। আরেক গ্র“পের নেতা মন্ত্রী সুলতান আহমদ। রাষ্ট্রপতি দুই গ্র“পকে নিয়ে বসবেন। সেই সঙ্গে তিনি তার অন্যান্য কাজও করবেন। ২৯ মে রাতে বসলেন বিএনপির জেলা নেতাদের নিয়ে। সঙ্গে ছিলেন দলের মহাসচিব ডা. বদর“দ্দোজা চৌধুরীসহ আরও কয়েকজন। রাষ্ট্রপতির উপ¯ি’তিতেই অনেক রাত পর্যন্ত দুই গ্র“পের বিবাদ-বিসম্ব^াদ চলেছে। সবাইকে বিদায় দিয়ে তিনি দোতলায় গেলেন। তারপর সেই মর্মান্তিক ঘটনা। যে ঘটনা দেশের ইতিহাসের গতিধারা আরেকবার বদলে দিল। 
রাষ্ট্রপতিকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার বিশদ বিবরণ এখন কারও অজানা নয়। পরবর্তী সময়ে ওই রাতের সার্কিট হাউস অভিযানে অংশগ্রহণকারীদের কারও কারও কাছ থেকে আমি তাদের অপারেশনের বিস্তারিত শুনেছি। শুর“ থেকে শেষ পর্যন্ত। কিভাবে, কোন প্রেক্ষাপটে ঘটনাটি ঘটেছে। তা থেকে আমার ধারণা হয় যে, মিশনটি ‘কিলার মিশন’ ছিল না। মিশনের একজন সদস্য অন্যদের অগোচরে ‘কিলার’ হিসেবে বিশেষ কোন ‘এসাইনমেন্ট’ নিয়ে ওই কাজটি করেছে। 
মঞ্জুর রাষ্ট্র পরিচালনায় সেনাবাহিনীর আরও প্রত্যক্ষ ভূমিকায় থাকার পক্ষে ছিলেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, তিনি অনেক দিন ধরেই জিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করছিলেন পার্লামেন্ট ও মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে ‘বিপ্লবী সরকার’ গঠন করার জন্য। জিয়াই যার নেতৃত্বে থাকবেন। জিয়া রাজি হ”িছলেন না। ‘অভিযান’কারীদের ভাষ্য অনুযায়ী তাদের উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রপতিকে ক্যান্টনমেন্টে যেতে বাধ্য করা এবং সেখানে মঞ্জুরের উপ¯ি’তিতে তাদের দাবি মতো সিদ্ধান্ত কার্যকর করা। জনাব শামসুদ্দিনও সে কথাই বলেছেন। আমি তার এই বয়ান বিশ্বাস করি। 
মঞ্জুর একজন দক্ষ ও চৌকস অফিসার ছিলেন এ কথা তার শত্র“রাও বলবেন। তার সঙ্গে আমার একবারই সামনাসামনি কথা হয়েছে, খুব সম্ভবত ১৯৭৭ সালে। দৈনিক দেশবাংলায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেশে অচিরেই নির্বাচন হতে পারে এরকম কিছু আভাস দেয়া হয়েছিল। লেখাটা তখনকার সেনাপতিদের কারও কারও পছন্দ হয়নি, কারণÑ নির্বাচনের চিন্তা তাদের মাথায় ছিল না। তাই সেনা সদর দফতরে আমার ডাক পড়ল। মঞ্জুর তখন সিজিএস। তিনি প্রতিবেদন সম্পর্কে সরাসরি কিছু না বলে নানা বিষয় নিয়ে কথা বললেন। সবশেষে বললেন, ‘ইলেকশন তো খুব সেন্সেটিভ ইস্যু। এ নিয়ে স্কুপ নিউজ না করাই ভালো’। আমি বললাম, ‘প্রতিবেদনটির শিরোনামে কিš‘ প্রশ্নবোধক চিহ্ন দেয়া আছে’। তিনি হেসে বললেন, ‘ওটা তো আপনাদের জার্নালিস্টিক কাভার’। ওই পর্যন্তই। এরপর তার সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার কোন সুযোগ আমার হয়নি। 
জিয়া সেনাবাহিনীতে শৃংখলা ফিরিয়ে এনেছিলেন। সেজন্য অনেক কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। সেজন্য অনেকে তার কঠোর সমালোচনা করে থাকেন। তবে সেনাবাহিনী এবং জাতীয় রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রে তিনি ঐক্য ও সমঝোতার ওপর বেশি জোর দিয়েছেন। এটাই সম্ভবত কাল হয়েছিল। দু’পক্ষই এতে নাখোশ ছিল। পাকিস্তান ফেরতদের একজনকে তিনি সেনাবাহিনীর প্রধান রেখে তাদের আ¯’া অর্জন করতে চেয়েছেন। তাদের খুশি করতে মঞ্জুরকে কমান্ড থেকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিš‘ তাতেও কাজ হল না। সম্ভবত তাকে তারই খেসারত দিতে হয়েছে। মঞ্জুরের চারপাশে তখন কিছু অনুগত ও অনুরক্ত জুনিয়র অফিসার জড়ো হয়েছিল। তারা মঞ্জুরের অবমূল্যায়নে ক্ষুব্ধ হবে সেটাই স্বাভাবিক। হতে পারে পুরো ব্যাপারটা তাদেরই অতি উৎসাহের পরিণতি। হতে পারে তারা মঞ্জুরের অজান্তেই কাজটি করেছে। হতে পারে এতে মঞ্জুরের পরোক্ষ সায় ছিল। তবে দেশের একপ্রান্তে চট্টগ্রামে বসে রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা যে অসম্ভব, সেটা অনুধাবনের ক্ষমতা মঞ্জুরের ছিল না, তা মনে করা মঞ্জুরের প্রতি চরম অবিচার হবে। এটা যদি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার লক্ষ্যে পরিকল্পিত ‘ক্যু’ হতো, তাহলে যে ধরনের প্র¯‘তি নেয়ার কথা তার বিন্দুমাত্র আভাসও কি ঘটনা পরবর্তীকালে দেখা গেছে? রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করা হয়েছে, তার লাশ পড়ে থাকল সার্কিট হাউসের বারান্দায়, সারা শহরে কোথাও ক্ষমতা দখলের কোন আলামত নেই। কোথাও সেনা মোতায়েন হয়নি। রেডিওতে মঞ্জুরের কণ্ঠ শোনা গেল অনেক বেলায়। পরিকল্পনাহীন অসংলগ্ন কথাবার্তা। ওটা স্পষ্টতই ক্ষমতা দখলকারী ‘ক্যু-দে-তা’র নায়কের কণ্ঠস্বর মনে হয়নি। 
তাহলে কার নির্দেশে সেদিন এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল?
শামসুদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা জিয়া ও মঞ্জুরের মধ্যে বিরাজমান বৈরিতাকে পুঁজি করে উভয়কে হত্যা করার পরিকল্পনা করে।’
কারা সেই ‘ষড়যন্ত্রকারী’?
সেই দিনগুলোতে দেশের ভেতরে জিয়া কাদের স্বার্থে আঘাত করেছেন? কারা তাদের স্বার্থ বিঘিœত হওয়ার আশংকায় তাকে সরিয়ে দেয়া অপরিহার্য মনে করেছে? 
রাষ্ট্রপতি জিয়া তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য শুর“ থেকেই ডান-বামের সংমিশ্রণ ঘটাতে চেষ্টা করেছেন। প্রথমে ‘জাগদল’ তারপর বিএনপির যাত্রা শুর“ হয়েছিল সেভাবেই। কিš‘ তার মৃত্যুর আগের দিনগুলোতে তার রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় কিছু মৌলিক পরিবর্তন আসতে শুর“ করেছিল। ডান বা বাম নয়, একটা সা”চা মধ্যপš’ী দল হিসেবে বিএনপিকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর কাজ শুর“ হয়েছিল। আর সেজন্য মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের ব্যক্তিদের দলে টেনে আনার জন্য তিনি বিশেষ আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন।
মন্ত্রিসভাও সেভাবে ঢেলে সাজানোর ব্যাপারে তিনি কিছু বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই যা কার্যকর হতো। প্রধানমন্ত্রীর কাছে কোন গুর“ত্বপূর্ণ ফাইল যা”েছ না বেশ কয়েক মাস। একজন নতুন প্রধানমন্ত্রী শিগগিরই শপথ নেবেন। এমন সব খবর তখন বাতাসে ভাসছে। এই পরিবর্তনে যাদের পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা, তারা নিশ্চুপ থাকবে কেন? 
একনায়ক এবং একনায়কের দল
রাষ্ট্র পরিচালনায় জিয়া ‘একনায়ক’ ছিলেন। এককভাবেই সিদ্ধান্ত নিতেন। যদিও সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তিনি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করতেন। সিদ্ধান্ত নিতেন নিজেই। আমাদের বর্তমানকালের ‘পার্লামেন্টারি একনায়ক’দের মতোই তিনি এক”ছত্র ক্ষমতা ভোগ করেছেন। তবে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে নিজের কোন বৈষয়িক স্বার্থ তার বিবেচনায় থাকত বলে তার শত্র“রাও বলতে পারবেন না। তার শাসনে ‘পরিবারতন্ত্রে’র ছায়ামাত্রও ছিল না। সেখানেই তিনি আজকের একনায়কদের চেয়ে ভিন্ন। তার রেখে যাওয়া দল থেকেও।
তবে নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার ব্যাপারে তিনি একনায়কের মতোই আচরণ করেছেন। রাজনীতিকদের বশে রাখতে সামরিক ছাউনি এবং সামরিক ছাউনিকে বশে রাখার জন্য বাইরের রাজনৈতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন। এক্ষেত্রে তার কোন সঙ্গী ছিল বলে আমার মনে হয় না। সেজন্যই তার মৃত্যুর পর তার এত জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও তার দলটি নোঙরবিহীন তরণীর মতো তলিয়ে যেতে বসেছিল। 
’৮১তে একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার এক বছরের মাথায় তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক শাসন জারি করা হয়। তারপর শুর“ হয় বিএনপিকে সরকারি দল বানানোর চক্রান্ত। দলের অধিকাংশ মন্ত্রী, এমপি ও সিনিয়র নেতারা তাতে সায় দিয়ে সামরিক শাসকের অনুগামী হয়েছেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কনভেনশন ডেকে সারাদেশের বিএনপি নেতাকর্মীদের জড়ো করে বিএনপির নেতৃত্ব কুক্ষিগত করার চেষ্টা হয়েছে। সেই দিনগুলোতে মাত্র গুটি কয়েকজন সেই ডুবন্ত তরণী ভাসমান রাখার জন্য প্রাণান্ত পরিশ্রম করেছি। অন্যান্য দলের বন্ধুরা সেই প্রচেষ্টা দেখে বলেছে, ‘কেন মিছেমিছি এত পরিশ্রম করছ। দুনিয়ার কোথায়ও কি ডিক্টেটরের বিদায়ের পর তার দল টিকে থেকেছে?’ 
কথাটা ঠিক। কিš‘ ‘একনায়ক’ জিয়াউর রহমানের দল সে যাত্রায় রক্ষা পেয়েছে। শুধু দলের তর“ণ নেতাকর্মীদের অদম্য দৃঢ়তা এবং উৎসাহে। মন্ত্রী, এমপি ও সিনিয়র নেতাদের অধিকাংশের বিরোধিতা বা নিষ্ক্রিয়তা সত্ত্বেও। তবে ‘একনায়কের দল’ হিসেবে নয়, নতুন পরি¯ি’তিতে স্বৈরশাসনের বির“দ্ধে একটি লড়াকু দল হিসেবেই শুর“ হয়েছিল দলটির নবযাত্রা। সম্পূর্ণ নতুনভাবে। পরিণতি যাই হোক না কেন। 
শেষ কথা 
মঞ্জুরের হত্যার বিষয়ে বলতে গিয়ে শামসুদ্দিন আহমদ লিখেছেন, তাকে হত্যা করা হয়েছে ‘ঠাণ্ডা মাথায়। তার মাথায় ছিল একটিমাত্র গুলির চিহ্ন।’ যতদূর জানা যায়, মঞ্জুর তখন সম্পূর্ণরূপেই ঢাকার কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। তাই উপরের নির্দেশ ছাড়া এমন ঘটনা ঘটানোর কোন সুযোগ ওই সময় ছিল না। জিয়ার ‘হত্যাকারী’ হিসেবে তার তো ফাঁসি অবধারিতই ছিল। তাহলে তাকে সরিয়ে দেয়ার প্রয়োজন হল কেন? কে দিয়েছিল সেই নির্দেশ?
রাষ্ট্রপতি জিয়ার সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল তিনি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপসহীন ছিলেন। শক্তিমানদের কাছে যা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। বাইরের বন্ধুত্বের চেয়ে নিজ দেশের স্বার্থকে তিনি বড় করে দেখেছেন। ছোট দেশের শাসকের জন্য এর চেয়ে বড় ‘অযোগ্যতা’ আর কিছু নেই। এরকম রাষ্ট্রনেতাদের জীবনে সর্বত্রই দুর্ভাগ্য নেমে এসেছে। জিয়া তার ব্যতিক্রম হতে পারলেন না। এই দেশে আজ্ঞাবহ এবং অনুগত শাসক যাদের প্রয়োজন, তাদের জন্য তিনি কি বাধা হয়ে উঠেছিলেন?
আরেকটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন
আমার মনে আরেকটি প্রশ্ন : বঙ্গবন্ধুর হত্যাও কি একই সূত্রে গাঁথা? কারণ, রাজনৈতিক অব¯’ান ভিন্ন হলেও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু সম্ভবত আরও বেশি আপসহীন ছিলেন। 
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী : রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক
ংযধঢ়ংযরহ@মঃষনফ.পড়স 
বঙ্গবন্ধু, জিয়া ও মঞ্জুর হত্যা কি একসূত্রে গাঁথা?




ড. ফে র দৌ স আ হ ম দ কোরেশী
জনাব শামসুদ্দিন আহমদ, রাষ্ট্রপতির সাবেক সামরিক সচিব, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং জেনারেল মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ড বিষয়ে কিছু গুর“ত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরেছেন (‘মঞ্জুর কি সত্যই জিয়াকে হত্যা করেছিলেন?’, যুগান্তর, ৮ জুন, ২০১২)। 
তিনি লিখেছেন,
‘জিয়া ও মঞ্জুর হত্যা ছিল একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল সেনাবাহিনীকে পর্যায়ক্রমে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনামুক্ত করা এবং একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত রাজনৈতিক শক্তির কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা। এ ষড়যন্ত্রের মূল হোতা দেশের স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ও তাদের বিদেশী পৃষ্ঠপোষক, যারা নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সেনাবাহিনীর পাকিস্তান ফেরত অফিসারদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে ঃ।’
কিছু প্রশ্ন গত ৩২ বছর ধরে আমার হƒৎপিণ্ডে রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে চলেছে। আমার মনের গহিনে বরাবরই কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দেয়, কেন জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হল? কেন মঞ্জুর এভাবে নিহত হলেন? কেন ১২-১৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে জিয়া হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দেয়া হল? তাদের মৃত্যুদণ্ড দিতে এত তড়িঘড়ি করা হল কেন? 
আমার কষ্ট অনেক গুণে বেড়ে যায় যখন মনে করি জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি, যে দলের পত্তন ও অগ্রযাত্রায় আমি আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময় এবং আমার দক্ষতা-সক্ষমতা সবটুুকু উজাড় করে দিয়েছিলাম, সেই দলটি ১০ বছর ক্ষমতায় থেকেও এসব প্রশ্নের মীমাংসার কোন উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। এমনকি জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়া সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার পরও এ বিষয়টি নিয়ে কোন উ”চবাচ্য করেননি। কেন? কেন?
(শেখ হাসিনাকে সাধুবাদ জানাতে হয় অন্তত এই জন্য যে, তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার সম্পন্ন করার কাজে তার দায়িত্ব পালন করেছেন।) 
প্রশ্নগুলো খুবই স্পর্শকাতর। জনাব শামসুদ্দিন আহমদ এতদিন পরে হলেও বিষয়টি সাহসের সঙ্গে আলোচনায় এনেছেন। সে জন্য তাকে অন্তর থেকে ধন্যবাদ জানা”িছ। তিনি সেই সময় সেনাবাহিনীতে গুর“ত্বপূর্ণ দায়িত্বে কর্মরত ছিলেন। অনেক কিছু তার জানা থাকার কথা, যা বাইরে থেকে যথাযথ জানা সম্ভব ছিল না। জাতির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের জন্য অতীতের অমীমাংসিত প্রশ্নাবলীর জবাব জাতির সামনে স্পষ্ট হওয়া একান্তই জর“রি। 
তার লেখাটি পড়ে ৩১ বছর আগেকার সেই মর্মান্তিক ঘটনাবলীর দৃশ্যপট আবার মানসপটে ভেসে উঠছে। আমার বরাবরের বিশ্বাস, মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটিত হলেই জিয়া হত্যারও একটা কূলকিনারা খুঁজে পাওয়া যাবে। 
কিছু স্মৃতি
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আমি তখন বিএনপির সংগঠন গড়ে তোলার কাজে লিপ্ত থেকে দলের চেয়ারম্যানের সঙ্গে প্রায় সার্বক্ষণিক যোগাযোগে থেকেছি। রাষ্ট্রপতি মূলত দলের কিছু সাংগঠনিক বিরোধ মেটানোর জন্যই সেবারে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন। অন্তত বাইরে সেভাবেই প্রকাশ ছিল। তার দু’দিন আগে গিয়েছিলেন সিলেট। সেখানেও তিনি দলের ভেতরের দুটি গ্র“পের বিবাদ সরেজমিন বুঝে ব্যব¯’া নিয়েছেন। সিলেট থেকে ফিরেই চট্টগ্রাম। 
যতদূর মনে পড়ে ২৮ মে বিকালের দিকে ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর রোডের পার্টি অফিসে গিয়ে নিচে রাষ্ট্রপতির গাড়িবহর দেখলাম। জানলাম প্রেসিডেন্ট দোতলায় তার র“মে বসেছেন। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছি, এমন সময় দুপ্দাপ্ করে তিনি উপর থেকে নেমে আসছেন। আমি সালাম জানিয়ে সিঁড়ির একপাশে সরে দাঁড়ালাম। রাষ্ট্রপতি একটু থেমে মুচকি হেসে আমার দিকে ঝুঁকে চাপা স্বরে বললেনÑ ‘চিড়িয়াগুলো ঠিক আছে তো?’ আমিও হেসে বললাম, ‘ঠিক আছে’। তিনি সিঁড়ির আরেক ধাপ নেমে পেছনে না ফিরেই বললেন, ‘প্রোগ্রাম ঠিক?’ আমি তখন তাকে অনুসরণ করে নেমে আসছি। পেছন থেকে বললাম, ‘সব ঠিক’। (এই ‘চিড়িয়া’ প্রসঙ্গ এখন থাক।)
প্রেসিডেন্ট নিচে নেমে গাড়িতে উঠলেন। আমরা তাকে বিদায় জানালাম। হায়, তখন কি জানতাম, এটাই শেষ দেখা! চারদিন পর ৩ জুন ফিরে এলো তার মৃতদেহ! 
চট্টগ্রামের বিএনপিতে তখন দু’গ্র“পে বেজায় দ্বন্দ্ব। এক গ্র“পের নেতা উপ-প্রধানমন্ত্রী জামাল উদ্দিন আহমদ। আরেক গ্র“পের নেতা মন্ত্রী সুলতান আহমদ। রাষ্ট্রপতি দুই গ্র“পকে নিয়ে বসবেন। সেই সঙ্গে তিনি তার অন্যান্য কাজও করবেন। ২৯ মে রাতে বসলেন বিএনপির জেলা নেতাদের নিয়ে। সঙ্গে ছিলেন দলের মহাসচিব ডা. বদর“দ্দোজা চৌধুরীসহ আরও কয়েকজন। রাষ্ট্রপতির উপ¯ি’তিতেই অনেক রাত পর্যন্ত দুই গ্র“পের বিবাদ-বিসম্ব^াদ চলেছে। সবাইকে বিদায় দিয়ে তিনি দোতলায় গেলেন। তারপর সেই মর্মান্তিক ঘটনা। যে ঘটনা দেশের ইতিহাসের গতিধারা আরেকবার বদলে দিল। 
রাষ্ট্রপতিকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার বিশদ বিবরণ এখন কারও অজানা নয়। পরবর্তী সময়ে ওই রাতের সার্কিট হাউস অভিযানে অংশগ্রহণকারীদের কারও কারও কাছ থেকে আমি তাদের অপারেশনের বিস্তারিত শুনেছি। শুর“ থেকে শেষ পর্যন্ত। কিভাবে, কোন প্রেক্ষাপটে ঘটনাটি ঘটেছে। তা থেকে আমার ধারণা হয় যে, মিশনটি ‘কিলার মিশন’ ছিল না। মিশনের একজন সদস্য অন্যদের অগোচরে ‘কিলার’ হিসেবে বিশেষ কোন ‘এসাইনমেন্ট’ নিয়ে ওই কাজটি করেছে। 
মঞ্জুর রাষ্ট্র পরিচালনায় সেনাবাহিনীর আরও প্রত্যক্ষ ভূমিকায় থাকার পক্ষে ছিলেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, তিনি অনেক দিন ধরেই জিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করছিলেন পার্লামেন্ট ও মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে ‘বিপ্লবী সরকার’ গঠন করার জন্য। জিয়াই যার নেতৃত্বে থাকবেন। জিয়া রাজি হ”িছলেন না। ‘অভিযান’কারীদের ভাষ্য অনুযায়ী তাদের উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রপতিকে ক্যান্টনমেন্টে যেতে বাধ্য করা এবং সেখানে মঞ্জুরের উপ¯ি’তিতে তাদের দাবি মতো সিদ্ধান্ত কার্যকর করা। জনাব শামসুদ্দিনও সে কথাই বলেছেন। আমি তার এই বয়ান বিশ্বাস করি। 
মঞ্জুর একজন দক্ষ ও চৌকস অফিসার ছিলেন এ কথা তার শত্র“রাও বলবেন। তার সঙ্গে আমার একবারই সামনাসামনি কথা হয়েছে, খুব সম্ভবত ১৯৭৭ সালে। দৈনিক দেশবাংলায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেশে অচিরেই নির্বাচন হতে পারে এরকম কিছু আভাস দেয়া হয়েছিল। লেখাটা তখনকার সেনাপতিদের কারও কারও পছন্দ হয়নি, কারণÑ নির্বাচনের চিন্তা তাদের মাথায় ছিল না। তাই সেনা সদর দফতরে আমার ডাক পড়ল। মঞ্জুর তখন সিজিএস। তিনি প্রতিবেদন সম্পর্কে সরাসরি কিছু না বলে নানা বিষয় নিয়ে কথা বললেন। সবশেষে বললেন, ‘ইলেকশন তো খুব সেন্সেটিভ ইস্যু। এ নিয়ে স্কুপ নিউজ না করাই ভালো’। আমি বললাম, ‘প্রতিবেদনটির শিরোনামে কিš‘ প্রশ্নবোধক চিহ্ন দেয়া আছে’। তিনি হেসে বললেন, ‘ওটা তো আপনাদের জার্নালিস্টিক কাভার’। ওই পর্যন্তই। এরপর তার সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার কোন সুযোগ আমার হয়নি। 
জিয়া সেনাবাহিনীতে শৃংখলা ফিরিয়ে এনেছিলেন। সেজন্য অনেক কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। সেজন্য অনেকে তার কঠোর সমালোচনা করে থাকেন। তবে সেনাবাহিনী এবং জাতীয় রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রে তিনি ঐক্য ও সমঝোতার ওপর বেশি জোর দিয়েছেন। এটাই সম্ভবত কাল হয়েছিল। দু’পক্ষই এতে নাখোশ ছিল। পাকিস্তান ফেরতদের একজনকে তিনি সেনাবাহিনীর প্রধান রেখে তাদের আ¯’া অর্জন করতে চেয়েছেন। তাদের খুশি করতে মঞ্জুরকে কমান্ড থেকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিš‘ তাতেও কাজ হল না। সম্ভবত তাকে তারই খেসারত দিতে হয়েছে। মঞ্জুরের চারপাশে তখন কিছু অনুগত ও অনুরক্ত জুনিয়র অফিসার জড়ো হয়েছিল। তারা মঞ্জুরের অবমূল্যায়নে ক্ষুব্ধ হবে সেটাই স্বাভাবিক। হতে পারে পুরো ব্যাপারটা তাদেরই অতি উৎসাহের পরিণতি। হতে পারে তারা মঞ্জুরের অজান্তেই কাজটি করেছে। হতে পারে এতে মঞ্জুরের পরোক্ষ সায় ছিল। তবে দেশের একপ্রান্তে চট্টগ্রামে বসে রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা যে অসম্ভব, সেটা অনুধাবনের ক্ষমতা মঞ্জুরের ছিল না, তা মনে করা মঞ্জুরের প্রতি চরম অবিচার হবে। এটা যদি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার লক্ষ্যে পরিকল্পিত ‘ক্যু’ হতো, তাহলে যে ধরনের প্র¯‘তি নেয়ার কথা তার বিন্দুমাত্র আভাসও কি ঘটনা পরবর্তীকালে দেখা গেছে? রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করা হয়েছে, তার লাশ পড়ে থাকল সার্কিট হাউসের বারান্দায়, সারা শহরে কোথাও ক্ষমতা দখলের কোন আলামত নেই। কোথাও সেনা মোতায়েন হয়নি। রেডিওতে মঞ্জুরের কণ্ঠ শোনা গেল অনেক বেলায়। পরিকল্পনাহীন অসংলগ্ন কথাবার্তা। ওটা স্পষ্টতই ক্ষমতা দখলকারী ‘ক্যু-দে-তা’র নায়কের কণ্ঠস্বর মনে হয়নি। 
তাহলে কার নির্দেশে সেদিন এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল?
শামসুদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা জিয়া ও মঞ্জুরের মধ্যে বিরাজমান বৈরিতাকে পুঁজি করে উভয়কে হত্যা করার পরিকল্পনা করে।’
কারা সেই ‘ষড়যন্ত্রকারী’?
সেই দিনগুলোতে দেশের ভেতরে জিয়া কাদের স্বার্থে আঘাত করেছেন? কারা তাদের স্বার্থ বিঘিœত হওয়ার আশংকায় তাকে সরিয়ে দেয়া অপরিহার্য মনে করেছে? 
রাষ্ট্রপতি জিয়া তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য শুর“ থেকেই ডান-বামের সংমিশ্রণ ঘটাতে চেষ্টা করেছেন। প্রথমে ‘জাগদল’ তারপর বিএনপির যাত্রা শুর“ হয়েছিল সেভাবেই। কিš‘ তার মৃত্যুর আগের দিনগুলোতে তার রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় কিছু মৌলিক পরিবর্তন আসতে শুর“ করেছিল। ডান বা বাম নয়, একটা সা”চা মধ্যপš’ী দল হিসেবে বিএনপিকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর কাজ শুর“ হয়েছিল। আর সেজন্য মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের ব্যক্তিদের দলে টেনে আনার জন্য তিনি বিশেষ আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন।
মন্ত্রিসভাও সেভাবে ঢেলে সাজানোর ব্যাপারে তিনি কিছু বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই যা কার্যকর হতো। প্রধানমন্ত্রীর কাছে কোন গুর“ত্বপূর্ণ ফাইল যা”েছ না বেশ কয়েক মাস। একজন নতুন প্রধানমন্ত্রী শিগগিরই শপথ নেবেন। এমন সব খবর তখন বাতাসে ভাসছে। এই পরিবর্তনে যাদের পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা, তারা নিশ্চুপ থাকবে কেন? 
একনায়ক এবং একনায়কের দল
রাষ্ট্র পরিচালনায় জিয়া ‘একনায়ক’ ছিলেন। এককভাবেই সিদ্ধান্ত নিতেন। যদিও সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তিনি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করতেন। সিদ্ধান্ত নিতেন নিজেই। আমাদের বর্তমানকালের ‘পার্লামেন্টারি একনায়ক’দের মতোই তিনি এক”ছত্র ক্ষমতা ভোগ করেছেন। তবে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে নিজের কোন বৈষয়িক স্বার্থ তার বিবেচনায় থাকত বলে তার শত্র“রাও বলতে পারবেন না। তার শাসনে ‘পরিবারতন্ত্রে’র ছায়ামাত্রও ছিল না। সেখানেই তিনি আজকের একনায়কদের চেয়ে ভিন্ন। তার রেখে যাওয়া দল থেকেও।
তবে নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার ব্যাপারে তিনি একনায়কের মতোই আচরণ করেছেন। রাজনীতিকদের বশে রাখতে সামরিক ছাউনি এবং সামরিক ছাউনিকে বশে রাখার জন্য বাইরের রাজনৈতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন। এক্ষেত্রে তার কোন সঙ্গী ছিল বলে আমার মনে হয় না। সেজন্যই তার মৃত্যুর পর তার এত জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও তার দলটি নোঙরবিহীন তরণীর মতো তলিয়ে যেতে বসেছিল। 
’৮১তে একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার এক বছরের মাথায় তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক শাসন জারি করা হয়। তারপর শুর“ হয় বিএনপিকে সরকারি দল বানানোর চক্রান্ত। দলের অধিকাংশ মন্ত্রী, এমপি ও সিনিয়র নেতারা তাতে সায় দিয়ে সামরিক শাসকের অনুগামী হয়েছেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কনভেনশন ডেকে সারাদেশের বিএনপি নেতাকর্মীদের জড়ো করে বিএনপির নেতৃত্ব কুক্ষিগত করার চেষ্টা হয়েছে। সেই দিনগুলোতে মাত্র গুটি কয়েকজন সেই ডুবন্ত তরণী ভাসমান রাখার জন্য প্রাণান্ত পরিশ্রম করেছি। অন্যান্য দলের বন্ধুরা সেই প্রচেষ্টা দেখে বলেছে, ‘কেন মিছেমিছি এত পরিশ্রম করছ। দুনিয়ার কোথায়ও কি ডিক্টেটরের বিদায়ের পর তার দল টিকে থেকেছে?’ 
কথাটা ঠিক। কিš‘ ‘একনায়ক’ জিয়াউর রহমানের দল সে যাত্রায় রক্ষা পেয়েছে। শুধু দলের তর“ণ নেতাকর্মীদের অদম্য দৃঢ়তা এবং উৎসাহে। মন্ত্রী, এমপি ও সিনিয়র নেতাদের অধিকাংশের বিরোধিতা বা নিষ্ক্রিয়তা সত্ত্বেও। তবে ‘একনায়কের দল’ হিসেবে নয়, নতুন পরি¯ি’তিতে স্বৈরশাসনের বির“দ্ধে একটি লড়াকু দল হিসেবেই শুর“ হয়েছিল দলটির নবযাত্রা। সম্পূর্ণ নতুনভাবে। পরিণতি যাই হোক না কেন। 
শেষ কথা 
মঞ্জুরের হত্যার বিষয়ে বলতে গিয়ে শামসুদ্দিন আহমদ লিখেছেন, তাকে হত্যা করা হয়েছে ‘ঠাণ্ডা মাথায়। তার মাথায় ছিল একটিমাত্র গুলির চিহ্ন।’ যতদূর জানা যায়, মঞ্জুর তখন সম্পূর্ণরূপেই ঢাকার কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। তাই উপরের নির্দেশ ছাড়া এমন ঘটনা ঘটানোর কোন সুযোগ ওই সময় ছিল না। জিয়ার ‘হত্যাকারী’ হিসেবে তার তো ফাঁসি অবধারিতই ছিল। তাহলে তাকে সরিয়ে দেয়ার প্রয়োজন হল কেন? কে দিয়েছিল সেই নির্দেশ?
রাষ্ট্রপতি জিয়ার সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল তিনি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপসহীন ছিলেন। শক্তিমানদের কাছে যা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। বাইরের বন্ধুত্বের চেয়ে নিজ দেশের স্বার্থকে তিনি বড় করে দেখেছেন। ছোট দেশের শাসকের জন্য এর চেয়ে বড় ‘অযোগ্যতা’ আর কিছু নেই। এরকম রাষ্ট্রনেতাদের জীবনে সর্বত্রই দুর্ভাগ্য নেমে এসেছে। জিয়া তার ব্যতিক্রম হতে পারলেন না। এই দেশে আজ্ঞাবহ এবং অনুগত শাসক যাদের প্রয়োজন, তাদের জন্য তিনি কি বাধা হয়ে উঠেছিলেন?
আরেকটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন
আমার মনে আরেকটি প্রশ্ন : বঙ্গবন্ধুর হত্যাও কি একই সূত্রে গাঁথা? কারণ, রাজনৈতিক অব¯’ান ভিন্ন হলেও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু সম্ভবত আরও বেশি আপসহীন ছিলেন। 
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী : রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক
ংযধঢ়ংযরহ@মঃষনফ.পড়স 
বঙ্গবন্ধু, জিয়া ও মঞ্জুর হত্যা কি একসূত্রে গাঁথা?




ড. ফে র দৌ স আ হ ম দ কোরেশী
জনাব শামসুদ্দিন আহমদ, রাষ্ট্রপতির সাবেক সামরিক সচিব, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং জেনারেল মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ড বিষয়ে কিছু গুর“ত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরেছেন (‘মঞ্জুর কি সত্যই জিয়াকে হত্যা করেছিলেন?’, যুগান্তর, ৮ জুন, ২০১২)। 
তিনি লিখেছেন,
‘জিয়া ও মঞ্জুর হত্যা ছিল একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল সেনাবাহিনীকে পর্যায়ক্রমে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনামুক্ত করা এবং একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত রাজনৈতিক শক্তির কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা। এ ষড়যন্ত্রের মূল হোতা দেশের স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ও তাদের বিদেশী পৃষ্ঠপোষক, যারা নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সেনাবাহিনীর পাকিস্তান ফেরত অফিসারদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে ঃ।’
কিছু প্রশ্ন গত ৩২ বছর ধরে আমার হƒৎপিণ্ডে রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে চলেছে। আমার মনের গহিনে বরাবরই কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দেয়, কেন জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হল? কেন মঞ্জুর এভাবে নিহত হলেন? কেন ১২-১৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে জিয়া হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দেয়া হল? তাদের মৃত্যুদণ্ড দিতে এত তড়িঘড়ি করা হল কেন? 
আমার কষ্ট অনেক গুণে বেড়ে যায় যখন মনে করি জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি, যে দলের পত্তন ও অগ্রযাত্রায় আমি আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময় এবং আমার দক্ষতা-সক্ষমতা সবটুুকু উজাড় করে দিয়েছিলাম, সেই দলটি ১০ বছর ক্ষমতায় থেকেও এসব প্রশ্নের মীমাংসার কোন উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। এমনকি জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়া সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার পরও এ বিষয়টি নিয়ে কোন উ”চবাচ্য করেননি। কেন? কেন?
(শেখ হাসিনাকে সাধুবাদ জানাতে হয় অন্তত এই জন্য যে, তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার সম্পন্ন করার কাজে তার দায়িত্ব পালন করেছেন।) 
প্রশ্নগুলো খুবই স্পর্শকাতর। জনাব শামসুদ্দিন আহমদ এতদিন পরে হলেও বিষয়টি সাহসের সঙ্গে আলোচনায় এনেছেন। সে জন্য তাকে অন্তর থেকে ধন্যবাদ জানা”িছ। তিনি সেই সময় সেনাবাহিনীতে গুর“ত্বপূর্ণ দায়িত্বে কর্মরত ছিলেন। অনেক কিছু তার জানা থাকার কথা, যা বাইরে থেকে যথাযথ জানা সম্ভব ছিল না। জাতির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের জন্য অতীতের অমীমাংসিত প্রশ্নাবলীর জবাব জাতির সামনে স্পষ্ট হওয়া একান্তই জর“রি। 
তার লেখাটি পড়ে ৩১ বছর আগেকার সেই মর্মান্তিক ঘটনাবলীর দৃশ্যপট আবার মানসপটে ভেসে উঠছে। আমার বরাবরের বিশ্বাস, মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটিত হলেই জিয়া হত্যারও একটা কূলকিনারা খুঁজে পাওয়া যাবে। 
কিছু স্মৃতি
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আমি তখন বিএনপির সংগঠন গড়ে তোলার কাজে লিপ্ত থেকে দলের চেয়ারম্যানের সঙ্গে প্রায় সার্বক্ষণিক যোগাযোগে থেকেছি। রাষ্ট্রপতি মূলত দলের কিছু সাংগঠনিক বিরোধ মেটানোর জন্যই সেবারে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন। অন্তত বাইরে সেভাবেই প্রকাশ ছিল। তার দু’দিন আগে গিয়েছিলেন সিলেট। সেখানেও তিনি দলের ভেতরের দুটি গ্র“পের বিবাদ সরেজমিন বুঝে ব্যব¯’া নিয়েছেন। সিলেট থেকে ফিরেই চট্টগ্রাম। 
যতদূর মনে পড়ে ২৮ মে বিকালের দিকে ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর রোডের পার্টি অফিসে গিয়ে নিচে রাষ্ট্রপতির গাড়িবহর দেখলাম। জানলাম প্রেসিডেন্ট দোতলায় তার র“মে বসেছেন। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছি, এমন সময় দুপ্দাপ্ করে তিনি উপর থেকে নেমে আসছেন। আমি সালাম জানিয়ে সিঁড়ির একপাশে সরে দাঁড়ালাম। রাষ্ট্রপতি একটু থেমে মুচকি হেসে আমার দিকে ঝুঁকে চাপা স্বরে বললেনÑ ‘চিড়িয়াগুলো ঠিক আছে তো?’ আমিও হেসে বললাম, ‘ঠিক আছে’। তিনি সিঁড়ির আরেক ধাপ নেমে পেছনে না ফিরেই বললেন, ‘প্রোগ্রাম ঠিক?’ আমি তখন তাকে অনুসরণ করে নেমে আসছি। পেছন থেকে বললাম, ‘সব ঠিক’। (এই ‘চিড়িয়া’ প্রসঙ্গ এখন থাক।)
প্রেসিডেন্ট নিচে নেমে গাড়িতে উঠলেন। আমরা তাকে বিদায় জানালাম। হায়, তখন কি জানতাম, এটাই শেষ দেখা! চারদিন পর ৩ জুন ফিরে এলো তার মৃতদেহ! 
চট্টগ্রামের বিএনপিতে তখন দু’গ্র“পে বেজায় দ্বন্দ্ব। এক গ্র“পের নেতা উপ-প্রধানমন্ত্রী জামাল উদ্দিন আহমদ। আরেক গ্র“পের নেতা মন্ত্রী সুলতান আহমদ। রাষ্ট্রপতি দুই গ্র“পকে নিয়ে বসবেন। সেই সঙ্গে তিনি তার অন্যান্য কাজও করবেন। ২৯ মে রাতে বসলেন বিএনপির জেলা নেতাদের নিয়ে। সঙ্গে ছিলেন দলের মহাসচিব ডা. বদর“দ্দোজা চৌধুরীসহ আরও কয়েকজন। রাষ্ট্রপতির উপ¯ি’তিতেই অনেক রাত পর্যন্ত দুই গ্র“পের বিবাদ-বিসম্ব^াদ চলেছে। সবাইকে বিদায় দিয়ে তিনি দোতলায় গেলেন। তারপর সেই মর্মান্তিক ঘটনা। যে ঘটনা দেশের ইতিহাসের গতিধারা আরেকবার বদলে দিল। 
রাষ্ট্রপতিকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার বিশদ বিবরণ এখন কারও অজানা নয়। পরবর্তী সময়ে ওই রাতের সার্কিট হাউস অভিযানে অংশগ্রহণকারীদের কারও কারও কাছ থেকে আমি তাদের অপারেশনের বিস্তারিত শুনেছি। শুর“ থেকে শেষ পর্যন্ত। কিভাবে, কোন প্রেক্ষাপটে ঘটনাটি ঘটেছে। তা থেকে আমার ধারণা হয় যে, মিশনটি ‘কিলার মিশন’ ছিল না। মিশনের একজন সদস্য অন্যদের অগোচরে ‘কিলার’ হিসেবে বিশেষ কোন ‘এসাইনমেন্ট’ নিয়ে ওই কাজটি করেছে। 
মঞ্জুর রাষ্ট্র পরিচালনায় সেনাবাহিনীর আরও প্রত্যক্ষ ভূমিকায় থাকার পক্ষে ছিলেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, তিনি অনেক দিন ধরেই জিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করছিলেন পার্লামেন্ট ও মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে ‘বিপ্লবী সরকার’ গঠন করার জন্য। জিয়াই যার নেতৃত্বে থাকবেন। জিয়া রাজি হ”িছলেন না। ‘অভিযান’কারীদের ভাষ্য অনুযায়ী তাদের উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রপতিকে ক্যান্টনমেন্টে যেতে বাধ্য করা এবং সেখানে মঞ্জুরের উপ¯ি’তিতে তাদের দাবি মতো সিদ্ধান্ত কার্যকর করা। জনাব শামসুদ্দিনও সে কথাই বলেছেন। আমি তার এই বয়ান বিশ্বাস করি। 
মঞ্জুর একজন দক্ষ ও চৌকস অফিসার ছিলেন এ কথা তার শত্র“রাও বলবেন। তার সঙ্গে আমার একবারই সামনাসামনি কথা হয়েছে, খুব সম্ভবত ১৯৭৭ সালে। দৈনিক দেশবাংলায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেশে অচিরেই নির্বাচন হতে পারে এরকম কিছু আভাস দেয়া হয়েছিল। লেখাটা তখনকার সেনাপতিদের কারও কারও পছন্দ হয়নি, কারণÑ নির্বাচনের চিন্তা তাদের মাথায় ছিল না। তাই সেনা সদর দফতরে আমার ডাক পড়ল। মঞ্জুর তখন সিজিএস। তিনি প্রতিবেদন সম্পর্কে সরাসরি কিছু না বলে নানা বিষয় নিয়ে কথা বললেন। সবশেষে বললেন, ‘ইলেকশন তো খুব সেন্সেটিভ ইস্যু। এ নিয়ে স্কুপ নিউজ না করাই ভালো’। আমি বললাম, ‘প্রতিবেদনটির শিরোনামে কিš‘ প্রশ্নবোধক চিহ্ন দেয়া আছে’। তিনি হেসে বললেন, ‘ওটা তো আপনাদের জার্নালিস্টিক কাভার’। ওই পর্যন্তই। এরপর তার সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার কোন সুযোগ আমার হয়নি। 
জিয়া সেনাবাহিনীতে শৃংখলা ফিরিয়ে এনেছিলেন। সেজন্য অনেক কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। সেজন্য অনেকে তার কঠোর সমালোচনা করে থাকেন। তবে সেনাবাহিনী এবং জাতীয় রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রে তিনি ঐক্য ও সমঝোতার ওপর বেশি জোর দিয়েছেন। এটাই সম্ভবত কাল হয়েছিল। দু’পক্ষই এতে নাখোশ ছিল। পাকিস্তান ফেরতদের একজনকে তিনি সেনাবাহিনীর প্রধান রেখে তাদের আ¯’া অর্জন করতে চেয়েছেন। তাদের খুশি করতে মঞ্জুরকে কমান্ড থেকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিš‘ তাতেও কাজ হল না। সম্ভবত তাকে তারই খেসারত দিতে হয়েছে। মঞ্জুরের চারপাশে তখন কিছু অনুগত ও অনুরক্ত জুনিয়র অফিসার জড়ো হয়েছিল। তারা মঞ্জুরের অবমূল্যায়নে ক্ষুব্ধ হবে সেটাই স্বাভাবিক। হতে পারে পুরো ব্যাপারটা তাদেরই অতি উৎসাহের পরিণতি। হতে পারে তারা মঞ্জুরের অজান্তেই কাজটি করেছে। হতে পারে এতে মঞ্জুরের পরোক্ষ সায় ছিল। তবে দেশের একপ্রান্তে চট্টগ্রামে বসে রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা যে অসম্ভব, সেটা অনুধাবনের ক্ষমতা মঞ্জুরের ছিল না, তা মনে করা মঞ্জুরের প্রতি চরম অবিচার হবে। এটা যদি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার লক্ষ্যে পরিকল্পিত ‘ক্যু’ হতো, তাহলে যে ধরনের প্র¯‘তি নেয়ার কথা তার বিন্দুমাত্র আভাসও কি ঘটনা পরবর্তীকালে দেখা গেছে? রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করা হয়েছে, তার লাশ পড়ে থাকল সার্কিট হাউসের বারান্দায়, সারা শহরে কোথাও ক্ষমতা দখলের কোন আলামত নেই। কোথাও সেনা মোতায়েন হয়নি। রেডিওতে মঞ্জুরের কণ্ঠ শোনা গেল অনেক বেলায়। পরিকল্পনাহীন অসংলগ্ন কথাবার্তা। ওটা স্পষ্টতই ক্ষমতা দখলকারী ‘ক্যু-দে-তা’র নায়কের কণ্ঠস্বর মনে হয়নি। 
তাহলে কার নির্দেশে সেদিন এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল?
শামসুদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা জিয়া ও মঞ্জুরের মধ্যে বিরাজমান বৈরিতাকে পুঁজি করে উভয়কে হত্যা করার পরিকল্পনা করে।’
কারা সেই ‘ষড়যন্ত্রকারী’?
সেই দিনগুলোতে দেশের ভেতরে জিয়া কাদের স্বার্থে আঘাত করেছেন? কারা তাদের স্বার্থ বিঘিœত হওয়ার আশংকায় তাকে সরিয়ে দেয়া অপরিহার্য মনে করেছে? 
রাষ্ট্রপতি জিয়া তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য শুর“ থেকেই ডান-বামের সংমিশ্রণ ঘটাতে চেষ্টা করেছেন। প্রথমে ‘জাগদল’ তারপর বিএনপির যাত্রা শুর“ হয়েছিল সেভাবেই। কিš‘ তার মৃত্যুর আগের দিনগুলোতে তার রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় কিছু মৌলিক পরিবর্তন আসতে শুর“ করেছিল। ডান বা বাম নয়, একটা সা”চা মধ্যপš’ী দল হিসেবে বিএনপিকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর কাজ শুর“ হয়েছিল। আর সেজন্য মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের ব্যক্তিদের দলে টেনে আনার জন্য তিনি বিশেষ আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন।
মন্ত্রিসভাও সেভাবে ঢেলে সাজানোর ব্যাপারে তিনি কিছু বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই যা কার্যকর হতো। প্রধানমন্ত্রীর কাছে কোন গুর“ত্বপূর্ণ ফাইল যা”েছ না বেশ কয়েক মাস। একজন নতুন প্রধানমন্ত্রী শিগগিরই শপথ নেবেন। এমন সব খবর তখন বাতাসে ভাসছে। এই পরিবর্তনে যাদের পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা, তারা নিশ্চুপ থাকবে কেন? 
একনায়ক এবং একনায়কের দল
রাষ্ট্র পরিচালনায় জিয়া ‘একনায়ক’ ছিলেন। এককভাবেই সিদ্ধান্ত নিতেন। যদিও সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তিনি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করতেন। সিদ্ধান্ত নিতেন নিজেই। আমাদের বর্তমানকালের ‘পার্লামেন্টারি একনায়ক’দের মতোই তিনি এক”ছত্র ক্ষমতা ভোগ করেছেন। তবে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে নিজের কোন বৈষয়িক স্বার্থ তার বিবেচনায় থাকত বলে তার শত্র“রাও বলতে পারবেন না। তার শাসনে ‘পরিবারতন্ত্রে’র ছায়ামাত্রও ছিল না। সেখানেই তিনি আজকের একনায়কদের চেয়ে ভিন্ন। তার রেখে যাওয়া দল থেকেও।
তবে নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার ব্যাপারে তিনি একনায়কের মতোই আচরণ করেছেন। রাজনীতিকদের বশে রাখতে সামরিক ছাউনি এবং সামরিক ছাউনিকে বশে রাখার জন্য বাইরের রাজনৈতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন। এক্ষেত্রে তার কোন সঙ্গী ছিল বলে আমার মনে হয় না। সেজন্যই তার মৃত্যুর পর তার এত জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও তার দলটি নোঙরবিহীন তরণীর মতো তলিয়ে যেতে বসেছিল। 
’৮১তে একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার এক বছরের মাথায় তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক শাসন জারি করা হয়। তারপর শুর“ হয় বিএনপিকে সরকারি দল বানানোর চক্রান্ত। দলের অধিকাংশ মন্ত্রী, এমপি ও সিনিয়র নেতারা তাতে সায় দিয়ে সামরিক শাসকের অনুগামী হয়েছেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কনভেনশন ডেকে সারাদেশের বিএনপি নেতাকর্মীদের জড়ো করে বিএনপির নেতৃত্ব কুক্ষিগত করার চেষ্টা হয়েছে। সেই দিনগুলোতে মাত্র গুটি কয়েকজন সেই ডুবন্ত তরণী ভাসমান রাখার জন্য প্রাণান্ত পরিশ্রম করেছি। অন্যান্য দলের বন্ধুরা সেই প্রচেষ্টা দেখে বলেছে, ‘কেন মিছেমিছি এত পরিশ্রম করছ। দুনিয়ার কোথায়ও কি ডিক্টেটরের বিদায়ের পর তার দল টিকে থেকেছে?’ 
কথাটা ঠিক। কিš‘ ‘একনায়ক’ জিয়াউর রহমানের দল সে যাত্রায় রক্ষা পেয়েছে। শুধু দলের তর“ণ নেতাকর্মীদের অদম্য দৃঢ়তা এবং উৎসাহে। মন্ত্রী, এমপি ও সিনিয়র নেতাদের অধিকাংশের বিরোধিতা বা নিষ্ক্রিয়তা সত্ত্বেও। তবে ‘একনায়কের দল’ হিসেবে নয়, নতুন পরি¯ি’তিতে স্বৈরশাসনের বির“দ্ধে একটি লড়াকু দল হিসেবেই শুর“ হয়েছিল দলটির নবযাত্রা। সম্পূর্ণ নতুনভাবে। পরিণতি যাই হোক না কেন। 
শেষ কথা 
মঞ্জুরের হত্যার বিষয়ে বলতে গিয়ে শামসুদ্দিন আহমদ লিখেছেন, তাকে হত্যা করা হয়েছে ‘ঠাণ্ডা মাথায়। তার মাথায় ছিল একটিমাত্র গুলির চিহ্ন।’ যতদূর জানা যায়, মঞ্জুর তখন সম্পূর্ণরূপেই ঢাকার কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। তাই উপরের নির্দেশ ছাড়া এমন ঘটনা ঘটানোর কোন সুযোগ ওই সময় ছিল না। জিয়ার ‘হত্যাকারী’ হিসেবে তার তো ফাঁসি অবধারিতই ছিল। তাহলে তাকে সরিয়ে দেয়ার প্রয়োজন হল কেন? কে দিয়েছিল সেই নির্দেশ?
রাষ্ট্রপতি জিয়ার সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল তিনি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপসহীন ছিলেন। শক্তিমানদের কাছে যা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। বাইরের বন্ধুত্বের চেয়ে নিজ দেশের স্বার্থকে তিনি বড় করে দেখেছেন। ছোট দেশের শাসকের জন্য এর চেয়ে বড় ‘অযোগ্যতা’ আর কিছু নেই। এরকম রাষ্ট্রনেতাদের জীবনে সর্বত্রই দুর্ভাগ্য নেমে এসেছে। জিয়া তার ব্যতিক্রম হতে পারলেন না। এই দেশে আজ্ঞাবহ এবং অনুগত শাসক যাদের প্রয়োজন, তাদের জন্য তিনি কি বাধা হয়ে উঠেছিলেন?
আরেকটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন
আমার মনে আরেকটি প্রশ্ন : বঙ্গবন্ধুর হত্যাও কি একই সূত্রে গাঁথা? কারণ, রাজনৈতিক অব¯’ান ভিন্ন হলেও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু সম্ভবত আরও বেশি আপসহীন ছিলেন। 
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী : রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক
ংযধঢ়ংযরহ@মঃষনফ.পড়স